অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ বাংলাদেশে আজ
প্রকাশিতঃ 10:30 am | December 07, 2020

প্রভাষ আমিন :
তিন দশক আগে এই বাংলাদেশে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মহৎ এক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সে আন্দোলনের একজন কর্মী ছিলাম, এটা আমাকে সারাজীবন গর্বিত করে। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি, তাদের সঙ্গী ছিল জামায়াতে ইসলামী। যারা অপরাধী, তাদের কাছেই বিচার চাইতে হয়েছিল আমাদের। বিচার তো হয়ইনি, উল্টো শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ গণআদালতের ২৪ সংগঠকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছিল।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা মাথায় নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল ক্যান্সার আক্রান্ত শহীদ জননীকে, যিনি নিজের শরীরের ক্যান্সারের চেয়ে দেশের ক্যান্সার দূর করাকেই জীবনের ব্রত করেছিলেন। তখন আমরা যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ তদন্তে মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছি। পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়েছি। যারা অপরাধী, তারাই ক্ষমতায় ছিল। অপরাধীর কাছেই বিচার চাইতে হয়েছিল। জানতাম বিচার পাবো না, তবুও নিজের বিবেকের কাছে নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেই সে আন্দোলনে শামিল ছিলাম। যখন তো জানতামই যে চাইছি বটে কিন্তু বিচার পাবো না।
এখন আর মৌলবাদীদের সাথে সমঝোতা, আপস, কৌশল, আলোচনা, দেখাদেখির সময় নেই। তারা বাংলাদেশের অস্তিত্বে হাত দিয়েছে। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গেছে, তাদের কালো হাত এক্ষুণি ভেঙ্গে দিতে হবে। প্রচলিত আইনে ব্যবস্থার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়তে হবে। জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন। এখন সময় সেই শকুনদের বাংলাছাড়া করার।
পরেও কখনো এই বাংলায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, সত্যি বলতে এটা আমার কল্পনায় ছিল না। শেখ হাসিনা দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে আমাকে কল্পনার চেয়েও বেশি স্বস্তি দিয়েছেন। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছে। দুটি কারণে আমি শেখ হাসিনাকে চিরদিন ধন্যবাদ জানাবো- বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এটা আমার ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা নয়। জাতি হিসেবেই আমাদের কলঙ্কমুক্ত করেছেন শেখ হাসিনা। বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, এটা যেমন আমার কল্পনার সীমানায় ছিল না। তেমনি এই বাংলায় কোনোদিন মৌলবাদীদের দাবি মেনে ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়া হবে, পাঠ্যপুস্তক বদলে দেয়া হবে, তারা কোনোদিন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার হুমকি দিতে পারবে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গতে পারবে; এটাও আমার কল্পনার সীমানায় ছিল না।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরের ২১ বছরেও বাংলাদেশে কেউ এতটা ঔদ্ধত্য দেখাতে পারেনি। আমার কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যিনি করেছেন, মৌলবাদীদের আস্ফালন দেখতে হচ্ছে সেই শেখ হাসিনার আমলেই; এ বড় বেদনার। বাংলাদেশের রাজনীতির একটা বড় টার্নিং পয়েন্ট ২০১৩ সালের ৫ মে। হেফাজতের ব্যানারে সেদিন সকল স্বাধীনতাবিরোধী আর মৌলবাদী শক্তি এক হয়ে মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিল, সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত থাকার প্রত্যয়ে। অনেকে ছায়া সরকার গঠন করে ফেলেছিলেন, মন্ত্রণালয়ের ভাগাভাগিও প্রায় শেষ। কিন্তু সৈয়দ আশরাফের এক হুমকি আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশলী অভিযানে রাতেই তাদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। সেদিন শাপলা চত্বর ঘিরে হেফাজতে ইসলাম বেশকিছু লোক জড়ো করতে পেরেছিল।
হেফাজতের নিয়ন্ত্রণে থাকা কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের এনে তারা ঢাকা শহর দখল করতে চেয়েছিল। শাপলা চত্বর ঘিরে যতটুকু জায়গা তারা দখল করতে পেরেছিল, তাতে ঠাসাঠাসি করে লাখ তিনেক লোক আটতে পারে, কিন্তু ১০ লাখ-২০ লাখ লোকের সমাবেশের ধারণা ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে কিছুটা বিচলিত করতে পেরেছিল হেফাজত। তাতে সরকারও কিছুটা বিচলিত হয়ে থাকবে। তাই যারা সরকার পতনের লক্ষ্য নিয়ে ঢাকায় এসেছিল, তাদের সাথেই সরকার একটা আপস বা কৌশল করে। সেই আপস বা কৌশলের পেছনে রেলের জমি বরাদ্দ দেয়া থেকে শুরু করে নগদ লেনদেনের কথাও বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
আপস হোক আর ভুল কৌশল হোক, সেটা করতে গিয়ে সরকার মৌলবাদীদের কিছুটা লাই দিয়েছে। তাদের কথামত বদলে গেছে পাঠ্যপুস্তক, হাইকোর্ট চত্বর থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে গ্রিক ভাস্কর্য। তাদের আপত্তিতে নারীনীতি বাস্তবায়ন করা যায়নি। পহেলা বৈশাখে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য। অথচ মৌলবাদীদের দৃষ্টিতে তা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি। এমনকি পহেলা বৈশাখ উদযাপনকেও তারা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি মনে করে। আবহমান বাংলার সংস্কৃতিকেই তারা হিন্দুয়ানী বলে ব্যঙ্গ করে। মৌলবাদীদের ব্যাপারে আমাদের সবারই একটা অপেক্ষার নীতি আছে। দেখি না কী করে। দেখি চোরা করে কী- এই নীতিতে দেখতে দেখতে তারা বাংলাদেশের অস্তিত্বে হাত দিয়েছে। লাই পেয়ে পেয়ে তাদের বাড় বেড়েছে। আওয়ামী লীগ আসলে দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষেছে। এখন সুযোগ বুঝে তারা ছোবল দিচ্ছে। তখনই আশঙ্কা ছিল বানরকে লাই দিয়ে মাথায় তুললে নামানো মুশকিল।
প্রয়াত জাসদ নেতা মঈনউদ্দিন খান বাদল তখনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, একদিন এরা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সরাতে বলবে। তার আশঙ্কা সত্যি হতে সময় লাগেনি। শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নয়, তারা সব ধরনের ভাস্কর্য সরাতে বলছে। বলে বসে থাকেনি। এই দুর্বৃত্তরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুদার ভাস্কর্য আর কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুর করেছে। লাই পেলে একদিন নিশ্চয়ই তারা শহীদ মিনার সরাতে বলবে, স্মৃতিসৌধ সরাতে বলবে। তাই সময় এসেছে রুখে দাঁড়াবার। এখনই জিরো টলারেন্স নীতিতে তাদের বিষ দাঁত ভেঙ্গে দিতে হবে। দেখার সময় ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই।
এখন আর মৌলবাদীদের সাথে সমঝোতা, আপস, কৌশল, আলোচনা, দেখাদেখির সময় নেই। তারা বাংলাদেশের অস্তিত্বে হাত দিয়েছে। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গেছে, তাদের কালো হাত এক্ষুণি ভেঙ্গে দিতে হবে। প্রচলিত আইনে ব্যবস্থার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়তে হবে। জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন। এখন সময় সেই শকুনদের বাংলাছাড়া করার।
তিন লাখ হোক আর ১০ লাখ, ৫ মে শাপলা চত্বরে সমাবেশ দেখে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। ১৮ কোটি মানুষের দেশে ১০ লাখ লোকের সমাবেশ বিশাল কিছু নয়। এরা একাত্তর সালে পরাজিত হয়েছে, ৫ মে তাদের পরাজয়েরই ইতিহাস। যতই লাফঝাঁপ করুক, তাদের ভোট কিন্তু ৫ ভাগ। তাই বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। সাহস নিয়ে লড়াই করতে হবে। যে উদার, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, মৌলবাদীরা তা হতে দিতে চায় না। তারা বাংলাদেশকে পেছনে টেনে নিতে চায়, আবার পাকিস্তান বানাতে চায়। কিন্তু ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ বাংলাদেশে আজ। সে আঁধার গ্রাস করে নিতে চাইছে আমাদের সব শুভ আকাঙ্খা। তবে জানি, রাত যত গভীর হয়, ভোর তত নিকটবর্তী। এ আঁধার কেটে নিশ্চয়ই নতুন সূর্য উঠবে উদার, অসাম্প্রদায়িক, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। তেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা সবসময় দেখি। ডিসেম্বর মাস এলে আমাদের সেই স্বপ্ন আরো উজ্জ্বল হয়।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ