জলাবদ্ধতা নিরসনে মন্ত্রীর ‘সাহসী’ সিদ্ধান্ত; আলোর মুখ দেখলো ওয়াসার প্রস্তাব!
প্রকাশিতঃ 7:48 pm | November 28, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
টেকসই কোন উদ্যোগ না থাকায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে রাজধানীবাসীকে বড় দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়। জাতীয় পার্টির শাসনামলে, ৩২ বছর আগে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ এক কলমের খোঁচায় তৎকালীন মিউনিসিপ্যালিটির অক্ষমতার জেরে ঢাকা ওয়াসাকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব দেন।
এরপর থেকেই মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশনসহ ৭ টি সংস্থা একত্রে কাজ করছিল। ফলশ্রুতিতে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিয়ে ওয়াসা আর সিটি করপোরেশনের মাঝে রশি টানাটানি হয়েছে দিনের পর দিন। চালুও হয়েছে একে অপরকে দোষারোপের সংস্কৃতি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান দায়িত্বগ্রহণ করে রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের বহমান গ্যাড়াকলের সুলুক সন্ধান করেন। এর ঠিক তিন বছরের মাথায় এ দায়িত্ব সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরে একাধিকবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ও হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের সদিচ্ছার অভাবে এটি বাস্তবায়ন হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় জলাবদ্ধতার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সঙ্কট নিরসনে নগরবাসীকে দুর্ভোগ থেকে বাঁচাতে জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ করেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো.তাজুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সানুগ্রহ অনুমতিতে ইতোমধ্যেই গত রোববার (১১ অক্টোবর) মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ সভা করেন।
সভায় নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয় দ্রুত ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের। আর এ কাজটি বাস্তবায়নের সুবিধার্থে একটি কারিগরি কমিটিও করে দিয়েছেন মন্ত্রী। আগামী এক মাসের মধ্যে এ কারিগরি কমিটির রিপোর্টের প্রেক্ষিতে হস্তান্তর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছে দায়িত্বশীল সূত্র।
তবে এখন কী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ ব্যবস্থা ওয়াসার কাছ থেকে সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর হবে, এজন্য দু’সিটি করপোরেশনের পর্যাপ্ত জনবল এবং সক্ষমতা আছে কীনা এসব বিষয় খতিয়ে দেখবে ওই কারিগরি কমিটি।
দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যা সমাধানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের বিচক্ষণ ও সাহসী সিদ্ধান্তকে নগরবাসী স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, ‘সঠিক ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে আক্ষরিক অর্থেই প্রশ্নাতীত আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়েছেন মন্ত্রী। তিনি সমস্যার গোড়ায় পৌঁছেছেন। অংশীজনদের নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছে কার্যকর সমাধানের পথ বের করেছেন।’
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ কালের আলোকে বলেন, ‘ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন ওয়াসার কাজ নয়। নগবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহ তাদের প্রধান দায়িত্ব। দুই নম্বর দায়িত্ব পয়:প্রণালী নিষ্কাশন ব্যবস্থা। কিন্তু ঢাকা শহরের খালগুলোর মাধ্যমে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হয় সেই দায়িত্ব ওয়াসা পালন করছিল। আইনে বলা আছে এগুলো সিটি করপোরেশন দেখবে।
নালা নর্দমার পানিগুলো প্রথমে খালে, খাল থেকে নদীতে এরপর সমুদ্রে যাবে। সুতরাং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাপনা সিটি করপোরেশনের পক্ষেই সম্ভব। যেহেতু আইনে বর্ণনা করা আছে এবং সিটি করপোরেশন সম্মতি জ্ঞাপন করেছে। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে সমঝোতা বৈঠকে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এগুলো এখন থেকে সিটি করপোরেশন দেখবে। তবে কোন পদ্ধতিতে কীভাবে হস্তান্তর হবে এজন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সময়োপযোগী এ সিদ্ধান্তের পর অনেকেই বিষয়টিকে দুই সিটি করপোরেশন ‘বিজয়’ এবং ঢাকা ওয়াসার ‘পরাজয়’ হিসেবে উল্লেখ করে পুনরায় জল ঘোলা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রকৃত অর্থে কোন শুভ উদ্যোগকে বরাবরই আড় চোখে দেখতে পারঙ্গম চক্রটি এর মাধ্যমে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছড়িয়ে দেওয়ার কারসাজি করছেন কীনা এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখার জোর দাবি উঠেছে।
সচিবালয়ে সেই পরামর্শ সভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘একসময় খালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হাতেই ছিল এবং আইনেও তাই আছে। পরবর্তী সময়ে কোনো এক সময়ে রাষ্ট্রপতির আদেশে সেটি ঢাকা ওয়াসার হাতে দেওয়া হয়। এখন দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র তারা খালের দায়িত্ব নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সবাই মিলে আলোচনায় বসে আমরা ওয়াসা থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে খালগুলো হস্তান্তরের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
সূত্র মতে, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান ২০১২, ২০১৪, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে একাধিকবার রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের হাতে হস্তান্তরে চিঠি লিখেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকেও বিভিন্ন সময়ে চারটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কখনই কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়নি।
একই সূত্র জানায়, ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ৮ বছর আগে যে প্রস্তাব করেছিল সেটিই এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে। আরও আগে এ প্রস্তাব আলোর মুখ দেখলে রাজধানীবাসী অনেক আগেই জলাবদ্ধতার শেকল থেকে বের হয়ে আসতে পারতো।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর দূরদর্শী এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড সুয়্যারেজে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পাবে বলেই মনে করেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। কালের আলো’র সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে তিনি ঢাকা ওয়াসার ম্যান্ডেটসহ নানা বিষয়ে যুক্তিনির্ভর বক্তব্যই উপস্থাপন করেন।
তাকসিম এ খান বলেন, ‘বৃষ্টির পানি, প্লাবনের পানি কিংবা বন্যার পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার ম্যান্ডেটে কোনদিনই ছিল না। ড্রেনেজ অথরিটি অর্থাৎ পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব আমাদের ছিলই না। বরং এটা আমাদের আইনে ছিল দেশের প্রতিটি শহরে সিটি করপোরেশন নিজ নিজ শহরে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্বে থাকবে।’
বিষয়টি খোলাসা করে তিনি বলেন, ‘পয়:নিষ্কাশন (হিউম্যান অ্যাসট্রাক্ট) আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বৃষ্টির পানি, প্লাবনের পানি আর বন্যার পানি সেটি পাইপ দিয়েই যাক আর খাল দিয়ে যাক সব মিলিয়ে হচ্ছে স্ট্রম ওয়াটার ড্রেনেজ সিস্টেম। আর এ পুরো বিষয়টি সিটি করপোরেশন দেখবে। এতোদিন ভাগাভাগি করে দায়িত্ব পালন করছিলাম। এখন ড্রেনেজ সিস্টেমের পুরোটাই সিটি করপোরেশনের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা নিজেরাই এককভাবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। এজন্য তাদেরকে কারিগরি থেকে শুরু করে লোকবলসহ সব রকমের সহায়তা দিতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।’
কালের আলো/এসআর/জিকেএম