বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি-কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ দেখছে আইসিএবি
প্রকাশিতঃ 10:44 pm | June 04, 2025

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, কালের আলো:
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগের বাধা মোকাবিলা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষায় উচ্চতর বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করছে দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)। এসব বিষয়ে সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে বুধবার (৪ জুন) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ চ্যালেঞ্জের কথা বলেন সংগঠনটির সভাপতি মারিয়া হাওলাদার। আইসিএবির কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
মারিয়া হাওলাদার বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০২৬ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যমান কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে যেমন- মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগের বাধা মোকাবিলা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সামাজিক সুরক্ষায় উচ্চতর বিনিয়োগ এসবের দিকে সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির দিক থেকে, দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার ৯ দশমিক ১৭ শতাংশের বেশি, যা উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ইঙ্গিত। মোট বাজেটের প্রায় ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ বা ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণগ্রহণের মাধ্যমে অর্থায়ন করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতির কারণ হতে পারে বলে আমরা মনে করছি।
টার্ন-ওভার করের হার-বৃদ্ধি করে দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ এবং ব্যক্তিদের জন্য শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ করা হয়েছে, যা করদাতার জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এছাড়া বাণিজ্যিক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম ভ্যাট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অনলাইনে বিক্রয় থেকে কমিশনের ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা সরকার আবারও বিবেচনা করতে পারে।
আইসিএবি সভাপতি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দ্বিপাক্ষিক সুবিধা পেতে কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার এবং কমানো হয়েছে। পেট্রোলিয়াম আমদানির ওপর আমদানি শুল্ক হ্রাস, অগ্রিম রুলিংয়ের মেয়াদ ১৮ মাস থেকে ৩৬ মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। তবে স্বাস্থ্যসেবা ও প্রয়োজনীয় পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করা হয়েছে, যা সরকার পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিবেচনা করে বিস্তারিত মনোযোগ দিয়ে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে একটি কৌশলগত এবং সময়োপযোগী বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার এ বাজেট সময়োপযোগী ও ব্যাপক আকারের বাজেট।
কয়েক বছর ধরে চলে আসা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জুলাই-আগস্ট বিপ্লব, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বৈশ্বিক সংকট, ডলার সংকট, ব্যবসা-বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মন্দা এবং অন্যান্য বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও সরকার ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিয়েছে, যা আমাদের একটি উন্নত দেশে পৌঁছাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
মারিয়া হাওলাদার বলেন, এ প্রথম বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় বাজেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দেশের নারীদের অবৈতনিক ও অস্বীকৃত সেবা এবং গৃহস্থালির কাজের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে এবং এর মাধ্যমে সরকার দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) গণনায় এ প্রথমবারের মতো নারীর অবৈতনিক শ্রমের অর্থনৈতিক মূল্য অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করছে— যা একটি বড় নীতিগত পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হবে।
আইসিএবি সভাপতি বলেন, আমরা দেখেছি যে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার পূর্বের বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে, যা ক্রমাগত অর্থনৈতিক সংগ্রাম মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত সংকোচনমূলক পদ্ধতির প্রতিফলন। গত অর্থবছরের বাজেটে মূল বরাদ্দের তুলনায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বরাদ্দ কমানো হয়েছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৩ দশমিক ৬২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং বিদেশি ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং সীমিত রাজস্ব স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কম বাজেট ঘাটতি নির্ধারণ করা একটি বুদ্ধিমানের পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি।
তিনি বলেন, অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা বিগত বছরের মূল লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৪১ লাখ কোটি টাকার চেয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। দেশের বিদ্যমান কর কাঠামো ও কর আদায় প্রক্রিয়ায় এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে। তবে করকাঠামো ও কর আদায় প্রক্রিয়ায় আধুনিকীকরণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছানো অসম্ভব কিছু নয়।
তিনি আরও বলেন, অর্থ উপদেষ্টা বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, কর আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে আগামী বছর থেকে সব করদাতার অনলাইনে বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা হচ্ছে। আমরা মনে করি অনলাইনে রিটার্ন জমা করদাতাদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সব করদাতার অনলাইনে বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা নিশ্চিত করা গেলে রিটার্ন জমাকারীর সংখ্যা বাড়বে।
দেশে ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতির চাপের পরিপ্রেক্ষিতে, নতুন বাজেটে ব্যক্তিগত করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে— কিন্তু ২০২৫-২৬ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর থেকে। এই কর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য খুব বেশি স্বস্তিদায়ক হবে না।
এছাড়া প্রান্তিক করদাতাদের ন্যূনতম কর ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা করা হলে প্রান্তিক করদাতাদের ওপর করের বোঝা বাড়বে। দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তি-শ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ করবর্ষের জন্য সাড়ে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো গেলে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর কিছুটা উপকার হতো। সরকারের উচিত কর জাল সম্প্রসারণ এবং কর ফাঁকি রোধ করে কর আদায়ের চেষ্টা করা। কর ব্যবস্থাকে আরও প্রগতিশীল এবং ন্যায়সঙ্গত করার জন্য সংস্কারও গ্রহণ করা প্রয়োজন- বলেন আইসিএবি সভাপতি।
তিনি বলেন, কোম্পানির লেনদেনের ওপর কর বা টার্নওভার কর দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের টার্নওভারের ওপর ন্যূনতম কর (মিনিমাম ট্যাক্স) করনীতির পরিপন্থি। ব্যবসায়ে লাভ হলেই শুধু করযোগ্য আয়ের ওপর কর আরোপ করা উচিত হবে বলে আমরা মনে করি। তাই এটি বাদ দেওয়া প্রয়োজন।
বাজেটে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য পরিকল্পিত কিছু করনীতি চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যেমন ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমাতে বেশ কয়েকটি পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার বা হ্রাস করা এবং অন্যান্য পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো। এ কর প্রস্তাবগুলোর লক্ষ্য বাজার অ্যাক্সেস এবং বাণিজ্য প্রতিযোগিতা বাড়ানো। বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
কালের আলো/এএএন