‘মব সন্ত্রাস’ নিয়ে উদ্বেগ-আতঙ্ক
প্রকাশিতঃ 6:24 pm | May 25, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই আলোচনায় আসে ‘মব সন্ত্রাস’। ক্রমশ এটি হয়ে আতঙ্কের নাম। দলবদ্ধ হয়ে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার ঘটনায় বেড়েছে উদ্বেগ। মব সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন রাজনীতিবিদ, পুলিশ, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক থেকে শুরু করে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে সর্বত্র এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, গত ৯ মাসে গণপিটুনিতে অন্তত ১৪৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৩৯ জন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মোট ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে। গত বছর এ ধরনের ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন।
জানা যায়, মব সন্ত্রাসের নামে এই ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়া, গণপিটুনি, হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটসহ একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছে দুষ্কৃতিকারী ছাড়াও সাধারণ নিরপরাধ মানুষ। একদিকে যেমন ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে মব সংস্কৃতির ঘটনাও। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও কিছু মানুষ সংঘটিত হয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে মবের ঘটনা সংঘটিত করছে, এতে বাড়ছে হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধ। ডাকাত-ছিনতাইকারীর পাশাপাশি অনেক সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও ঘায়েল হচ্ছে এই মব সন্ত্রাসে। ফলে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে নাগরিক সমাজে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী যখন ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়, তখনই জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চায়। এছাড়া মানুষ ক্ষোভ প্রশমনের জন্য অনেক সময় আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে চলেছে। অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশের পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়েছে বেশকিছু পদক্ষেপ। কিন্তু আশ্বস্ত হওয়ার মতো ব্যবস্থা মানুষ এখনো দেখছে না, তাই বাড়ছে আস্থাহীনতা। এটিও মব সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বের ৯ মাস পূর্ণ হওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে মব সৃষ্টিকারীদের শুধু প্রতিরোধের ঘোষণা ছাড়া উল্লেখযোগ্য আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এরই মধ্যে কয়েকদিন আগে ধানমন্ডিতে মব প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করায় ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) পুরস্কারে ভূষিত করেন ডিএমপি কমিশনার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
১৯ মে ধানমন্ডিতে মব সৃষ্টিকারীদের ঘটনার পরদিন ২০ মে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, ভবিষ্যতে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কোনো নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে তা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না।
বিজ্ঞপ্তিতে ধানমন্ডি ৪ নম্বর সড়কের ঘটনা উল্লেখ করা হয়। পেশাদারত্ব ও ধৈর্য সহকারে মব নিয়ন্ত্রণে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনের স্বীকৃতি হিসেবে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ক্যশৈন্যু মারমাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। গত বুধবার (২১ মে) ধানমন্ডি থানার ওসির হাতে পুরস্কার তুলে দেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আপনারা দেখেছেন, গত সোমবার ধানমন্ডি এলাকায় মব সৃষ্টিকারীদের কীভাবে প্রতিহত করেছে ধানমন্ডি থানার ওসিসহ তার পুলিশ বাহিনী। এতে পুলিশ প্রশংসিত হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। ব্যক্তিগত কারণে অথবা যে কোনো কারণেই কিছু লোকজন মবের নাম করে সমাজে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করলেই আইন অনুযায়ী তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। এই মবের কারণে নিহত-আহত হওয়ার ঘটনা আছে।
তবে মবের শিকার হয়ে এ পর্যন্ত কতজন নিহত ও আহত হয়েছেন, সেই সংখ্যা জানাতে পারেননি পুলিশের এই কর্মকর্তা।
এদিকে, গত ৯ মার্চ সচিবালয়ের আইন মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ের সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, জনগণকে জানাতে চাই, যেখানেই ‘মব জাস্টিস’ পরিস্থিতি হবে, সে যেই হোন না কেন, যে ধর্মের, লিঙ্গের, বর্ণের, জাতের হোন না কেন, আমরা এখন থেকে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হব। এখন থেকে যেকোনো ধরনের ‘মব জাস্টিসের’ বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে যাবে। যিনিই ‘মব জাস্টিস’ করেন না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনতে আজ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কালের আলো/এমএএইচএন