ডোনাল্ড লু’র ঢাকা সফরে রাজনীতিতে নতুন মোড়

প্রকাশিতঃ 10:33 am | January 17, 2023

কালের আলো রিপোর্ট:

ঢাকা ঘুরে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এ সফর নিয়ে সরকারি দল, সরকার বিরোধী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সুশীল সমাজের মধ্যে ছিল নানান জল্পনা-কল্পনা। কি ঘটতে যাচ্ছে? তবে কি র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে? কোন দিকে মোড় নিচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি? এমন নানা প্রশ্ন ছিল রাজনীতির অন্দরে-বাইরে। আলোচিত সফরকে ঘিরে খোশ খোশ ভাব ছিল বিরোধী পক্ষ বিএনপির বলয়ে। দলটির কেউ কেউ বলাবলিই করছিলেন, ডোনাল্ড লু বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হয়রানি না করার বিষয়ে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাবেন। নিরসন হবে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট।

শুধু তাই নয়, ডোনাল্ড লুর সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধি দল ভেতরে ভেতরে বৈঠক আয়োজনের সব প্রচেষ্টাই নিয়েছিল। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল বিএনপি। যদিও বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির নেতারা সফল হতে পারেননি। দিনশেষে মাথায় হাত পড়েছে ‘খোয়াব’ দেখা চক্রটির। রবিবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘দুই দেশের বন্ধুত্ব শক্তিশালী করতে এসেছি।’ র‍্যাব নিয়েও ইতিবাচক মনোভাবের কথা জানালেন। র‍্যাবের উন্নতির ধারাপাত চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। ডোনাল্ড লু বললেন, ‘নিষেধাজ্ঞার পর র‍্যাব সংস্কারে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা নেমে এসেছে আশাতীতভাবে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন মুল্লুকের প্রভাবশালী এই সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন মোড় নিয়েছে। তিনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কোন রকম কথা বলেননি। উল্টো বিভিন্ন বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তিনি অংশগ্রহণমূলক দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছেন।

বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা করে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন।’ তার কথায় সায় দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও। দৃঢ়তার সঙ্গেই তিনি বলেছেন, ‘আমরাও অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। আমার দল আওয়ামী লীগ সব সময় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় এসেছে। ব্যালটের মাধ্যমে এসেছে, বুলেটের মাধ্যমে নয়। আমাদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে।’

বিশ্লেষকদের চোখে ডোনাল্ড লু’র এই সফরে সরকারবিরোধীরা হোঁচট খেলেও আখেরে লাভবান হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ফলপ্রসু সফরে তিনি রীতিমতো উল্টে দিয়েছেন পাশার দান। ভেস্তে গেছে কুচক্রীদের মিশন প্রোপাগান্ডা।

বিশ্লেষকদের ভাষ্য হচ্ছে- বাংলাদেশ অতি প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটি উর্বর অঞ্চল। এ অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই, ব্রিটিশ, ফরাসিদের ব্যবসা বাণিজ্য চলছিল এবং এখনও তা চলমান রয়েছে। বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক খারাপ হলে বাংলাদেশের উর্বর ভূমি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করাটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সম্পর্ক অনেক দিনের। এখন থেকে এ সম্পর্ক আরও শক্ত হবে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, র‍্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা নাটকীয়ভাবে কমেছে। এ থেকে বোঝা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের।

সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে এ প্রসঙ্গে ডোনাল্ড লু বলেন, ‘আপনারা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি লক্ষ্য করলে দেখবেন, বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা কমানোর ক্ষেত্রে র‍্যাবের অসাধারণ অগ্রগতির কথা স্বীকার করা হয়েছে। আমরাও এই অগ্রগতির বিষয়টি স্বীকার করি। এটি একটি অসাধারণ কাজ। এতে প্রমাণিত হয়, মানবাধিকার সমুন্নত রেখে র‍্যাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সন্ত্রাসবাদ দমনে ভালো কাজ করছে।’

সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বলেন, ‘আমাদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। আমরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কোনো বিষয়ে সমস্যা থাকলে আমরা আলোচনা করি, পরামর্শ দিতে পারি। আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখায় বিশ্বাস করি। বাংলাদেশের মতো অংশীদারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করি।’

সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র সফরের মধ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে-নতুন করে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা আসছে না। পাশাপাশি র‍্যাবের বিষয়ে তার সন্তোষ প্রকাশই বলে দিচ্ছে শিগগির র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ওঠে যাচ্ছে। সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও শক্ত ও কঠিন হচ্ছে। তবে বিএনপি যে ধরনের গুঞ্জন ছড়িয়েছিল, তার কোনো প্রতিফলন ডোনাল্ড লু’র কোনো বক্তব্য বা আলোচনায় প্রতিফলিত হয়নি।

ডোনাল্ড লু বলেছেনই, ‘আমি এখানে এসেছি দুই দেশের বন্ধুত্বকে শক্তিশালী করতে, যখন বর্তমান বিশ্ব শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করে চলছে। শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে যে আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে আমরা গর্ব বোধ করি। শ্রম অধিকারের বিষয়টি আমরা কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, শ্রম অধিকারের মান উন্নয়নের বিষয়ে কীভাবে কাজ করতে পারি, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একে অপরকে সহযোগিতা করার বিষয়ে আমার আত্মবিশ্বাস রয়েছে।’

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও এসব বিষয় পুরোপুরি খোলাসা করেছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠেই উচ্চারণ করেছেন-সামনের ৫০ বছর সুদৃঢ় বন্ধুত্বের লক্ষ্য নিয়েই তারা এগোচ্ছেন। বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। কীভাবে সামনের ৫০ বছর সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের মধ্যে যদি কোনো কিছু নিয়ে সমস্যা থাকে, তবে আমরা আলোচনা করব। যদি গঠনমূলক পরামর্শ আসে, আমরা অবশ্যই তা গ্রহণ করব। এর নমুনা আমরা দেখিয়েছি। আমাদের যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, তা আমরা দূর করব।’

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনও বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। আমি নিজে খোলামেলা আলোচনা করেছি। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শ্রমপরিস্থিতি, নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, সহযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গত বছরের মতো এবারও আমাদের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, আমরা একটি সময়সূচি ধরে চলমান মেকানিজমের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পর্ককে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করব। আমাদের যে সম্পদ ও প্রক্রিয়া আছে, সেগুলো ব্যবহার করে সম্পর্ককে পরের ধাপে উন্নতি করব।’

কালের আলো/এমএইচ/ইএ