আইজিপির সংবাদ সম্মেলন; সঙ্কটে দেশপ্রেমের শাণিত শপথে পথের দিশা

প্রকাশিতঃ 9:03 pm | May 19, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। ভয়ঙ্কর এ ভাইরাসের বিস্তার রোধে নানা নিষেধাজ্ঞার পরেও সাধারণ মানুষের কান্ডজ্ঞানহীন নীতির কারণে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

আরও পড়ুনঃ বাঁচলে পরিবারের সঙ্গে আরও অনেকবার ঈদ করা যাবে: আইজিপি

এরই মধ্যে আবার দূয়ারে কড়া নাড়ছে ঈদ। ফলে রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যেতে এক রকম প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

সড়ক বা নৌপথে এ ভিড় বা স্রোত সামাল দিতে রীতিমতো ‘গলদঘর্ম’ হতে হচ্ছে পুলিশকে। দুইদিন আগে ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় এবং ঢাকা থেকে ঢাকার বাইরে কেউ যেন যেতে না পারেন সেই বিষয়ে নিজ বাহিনীর সদস্যদের কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.বেনজীর আহমেদ, বিপিএম (বার)।

এরপরও অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার বা মাইক্রোবাসচেপে নানা কৌশলে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকা ছাড়ার প্রবণতা যেন থামছেই না। ঘরে থাকা বা সামাজিক দূরত্ব মানার আদেশ লঙ্ঘন করায় এবার চূড়ান্ত বার্তা দিয়েছেন পুলিশ প্রধান ড.বেনজীর আহমেদ।

মঙ্গলবার (১৯ মে) রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মিলনায়তনে পবিত্র ঈদুল ফিতর ও করোনাভাইরাসে সৃষ্ট মহামারি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘মনে রাখতে হবে বেঁচে থাকলে আরও অনেকবার পরিবারের সঙ্গে ঈদ করা যাবে।

কিন্তু মারা গেলে কিংবা করোনা আক্রান্ত হলে এখানেই শেষ। এমন কিছু করবেন না, যাতে এই উৎসব জীবনের শেষ উৎসব হয়। নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে সরকারের নির্দেশনা মানতে হবে।’

পুলিশ প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নিজের প্রাজ্ঞ অভিব্যক্তির সঙ্গে দায়িত্বশীলতার শাণিত শপথ আর সময়ের প্রতিটি স্পন্দনের ঘটমানতাকে সামনে এনেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়।

আবার দিশা দিয়েছেন পথেরও। দেশের স্বার্থ আর গণমানুষকে সুরক্ষার বিষয়েও সোচ্চার থেকেছেন।

নিজের প্রথম এই সংবাদ সম্মেলনে ঈদুল ফিতরের উৎসবের দিনে মানুষকে ঘরে থাকা, মৃত্যুর দূত হয়ে পরিবারের সামনে হাজির না হওয়া, ফেরিঘাটে আটকে পড়াদের নিজেদের অবস্থানে ফেরত আসা, শপিংয়ের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি বা সুরক্ষা বিধিগুলো মেনে চলা, করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় জনগণের সহযোগিতা, গুজব সৃষ্টি করে সোশ্যাল মিডিয়া দূষণ, ঈদের নামাজে সরকার নির্দেশিত পথ অনুসরণ করাসহ ইত্যাকার বিষয়ে গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের এই ৩০ তম আইজি।

সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতার পথে অবিচল মানুষ হিসেবেই পরিচিত ড.বেনজীর আহমেদ। দীর্ঘ সময় পুলিশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সুনাম ও সফলতার সঙ্গেই। ডিএমপি কমিশনার বা এলিট ফোর্স র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন দু’টি ইউনিটকে।

সম্মিলিত পথচলায় বিশ্বাসী ড.বেনজীর আহমেদ বরাবরই কথাবার্তায় একেবারেই সোজা-সাপ্টা। এদিনের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘ঈদের সময়ে শহরে গ্রামে যে যেখানে আছেন, ফুর্তি করতে বের হবেন না।’

যাঁর যাঁর অবস্থানে থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন, বলেছেন ‘দয়া করে নিজের অবস্থান থেকে বের হবেন না। ঢাকা ছাড়বেন না এবং ঢাকায় আসবেন না। জীবনে অনেক ঈদ আসবে। তখন এসব করা যাবে। এমন কিছু করবেন না, যাতে এই উৎসব জীবনের শেষ উৎসব হয়।’

নিষেধাজ্ঞা স্বত্ত্বেও বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে অনেকেই ফেরিঘাটে আটকে পড়েছেন। তারা যে যেখানে ছিলেন, নিজেদের অবস্থানে ফেরত আসতে বলেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ।

তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘ফেরিঘাটে আটকা পড়াদের অনুরোধ, দয়া করে আপনারা যে যেখানে ছিলেন সেখানে ফিরে আসুন। যারা আটকে আছেন তাদের ফেরার জন্য প্রয়োজনে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।’

আইজিপি বলেছেন, ‘শপিংমলগুলো খোলা হয়েছে। আমরা মার্কেট সমিতির সঙ্গে কথা বলেছি, এসব বিষয়ে সরকার নির্দেশ জারি করেছেন। শপিংয়ের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি বা সুরক্ষা বিধিগুলো অবশ্যই আমাদের মেনে চলতে হবে।’

‘এক্ষেত্রে মার্কেট সমিতি, সেলসপার্সন, ক্রেতা সবাই বিষয়গুলো মানবেন। ৫ দোকান দেখে ১০ দোকান দেখে এক দোকানে শপিংয়ের যে আমাদের কালচার আছে, সেটাকে এবার পরিহার করাই ভালো। শপিংয়ের বেলায় আপনারা সতর্ক থাকবেন, যেন এটাই আপনার জীবনের শেষ শপিং না হয়’ যোগ করেন পুলিশ প্রধান।

তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, মেধাসম্পন্ন পুলিশের আইজি ড.বেনজীর আহমেদের বাগ্মীতা, বিনয় ও নম্রতা প্রাণিত করে সবাইকে। তাঁর বক্তব্যে ফুটে উঠে দেশ ও জাতির জন্য দায়বোধ, অপরিমেয় ভালোবাসা ও গভীর মমত্ববোধ।

পরমতসহিষ্ণুতা, প্রসন্নতা ও সামাজিক অগ্রগতিতে বিশ্বাসী এই মানুষটির বক্তব্যে হৃদয়ানুভূতি বা কঠোরতাও রয়েছে।

‘আমি বাড়ি যাব, অন্যরা ঢাকায় থাকবে এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মৃত্যুর মিছিলে আপনি হবেন একটি মাত্র সংখ্যা। কিন্তু আপনার পরিবারের কাছে আপনি একটি পৃথিবী।

তাই দায়িত্বহীন আচরণ করা চলবে না। দয়া করে যে যেখানে আছেন, সেখানেই অবস্থান করেন’ বলছিলেন আইজিপি।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর বেশি সংখ্যক আক্রান্তের জায়গাগুলোকে ক্লাস্টার হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং সেসব জায়গায় রোগটিও নিয়ন্ত্রণে আসে।

কিন্তু পরে রোগটি বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং সংক্রমণের হার বেড়ে যায়। সেই বিষয়টিও বেশ গুরুত্ব দিয়েই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করেন পুলিশ প্রধান।

তিনি বলেন, ‘গত এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশের ২৪ জেলা করোনা মুক্ত ছিল। পরে সাধারণ মানুষের চলাচলের কারণে সব জেলায় আক্রান্ত হলো।’ তিনি বাড়িমুখো মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনার গ্রামবাসীর কাছে মৃত্যুর দূত হয়ে যাবেন না।

ঢাকা শহরের চারপাশের মানুষকে নিরুৎসাহিত করছি। ফেরিঘাটে সতর্কতা চলছে। তারপরও অনেকে লঞ্চে-টলারে যাচ্ছেন। নৌপুলিশকে বলেছি তাদের ফিরিয়ে আনতে।’

ঈদুল ফিতরের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার বিষয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘মসজিদে নামাজের ব্যবস্থা করা হবে। সবাই মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ে দ্রুত বাসায় ফিরে যাবেন।

আনন্দ-ফূর্তি করার জন্য ঘর থেকে বের হবেন না। আমরা যদি ঈদুল আজহার আগে করোনা থেকে মুক্তি হতে পারি তাহলে আগামী ঈদ উদযাপন করব।’

বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতার সংগ্রামের মূল চেতনাকে ধারণ করে পথ চলে বাংলাদেশ পুলিশ। নির্ভীক পুলিশ সদস্যরা মানবিক নৈতিকতা ও গণমুখী মনোভাব নিয়ে পথ চলেন।

মানবিক সারসত্যের নিগূঢ়তম বাস্তবতা সর্বাগ্রে ও যোগ্যতার সাথে ছুটে চলার এমনই এক সুরধ্বনি সৃষ্টি করেছেন। দেশপ্রেম তাদের অস্থিমজ্জায় গ্রোথিত এবং প্রোথিত।

এক গণমাধ্যমকর্মীর প্রশ্নের উত্তরে দেশপ্রেমের প্রভা ও দীপ্তি ছড়িয়ে পুলিশ প্রধান বলেন, ‘করোনা ক্রাইসিস মোকাবিলায় অন্য দেশের পদক্ষেপ কপি-পেস্ট করতে পারব না। আমরা যেন দ্রুত অন্য কালচারে মোটিভেটেড হয়ে না যাই।

অন্য দেশের সেন্টিমেন্ট ও আমাদের দেশের সেন্টিমেন্ট এক নয়। আমরা গত দুইমাসে শারীরিক শক্তি বা ফোর্স প্রয়োগ না করে কাজ করেছি।’

নিজের পেশাগত দক্ষতা, সততা, নিষ্ঠা, কমিটমেন্ট ও প্রাগ্রসরতায় অগ্রপথিক এই পুলিশ প্রধানের নেতৃত্বেই দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনী করোনা সঙ্কটে অন্ধকার সরিয়ে আলোকবর্তিকা হাতে আলোর পথে ধাবিত করেছেন দেশকে।

মানবিক বিপর্যয় রুখে দিতে ক্লান্তিহীনভাবে পথ চলেছেন। জীবন দিয়েছেন। দেশের মানুষকে সুরক্ষায় নিজেরা সংক্রমিত হচ্ছেন, তবুও পিছু হটেননি। প্রতিটি জেলাতেই কর্মহীন গরিব ও দুস্থদের বাঁচিয়ে রাখতে নিত্যপণ্য বিতরণের কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন।

সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়েও কথা বলেছেন আইজিপি ড.বেনজীর। বলেছেন, ‘পুলিশ তার দায়িত্বের বাইরে গিয়ে কাজ করেছে, এখনো করছে। ঝুঁকি নিয়ে পুলিশ অনেক কাজ করেছে। যেখানে লাশের কাছে পরিবারের কেউ যেতে চায়নি, সেখানে পুলিশ গিয়েছে।

এ রকম হলে আক্রান্ত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। তবে পুলিশের জন্য আগাম সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং আক্রান্ত হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ তিনি আরও জানান, শুধু মাঠপর্যায়ের পুলিশই না, বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাও আক্রান্ত হয়েছেন।’

কালের আলো/এসআর/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email