ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিতঃ 9:04 am | February 21, 2020

অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ:

একুশ মানে মাথা নত না করা; একুশ মানে দৃপ্ত পথে এগিয়ে যাওয়া। একুশের চেতনায় আমরা এগিয়ে চলেছি, একুশের পথ ধরেই এসেছে বাংলার স্বাধীনতা।

মায়ের ভাষা বাংলা রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে আন্দোলনে নামে বাংলার দামাল ছেলেরা। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান সালাম-বরকত-রফিক-শফিক-জব্বার আরও কত নাম না-জানা কত শহীদ।

তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা ফিরে পাই আমাদের প্রাণের ভাষা, মায়ের মুখের বুলি, মধুর ভাষা বাংলা। ভাষা-একটি জাতির যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। এটি শুধু চিন্তা-চেতনা, মনন ও মনের ভাব প্রকাশের কেবল মাধ্যমই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশ ও জাতির আত্মপরিচয়। হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষা প্রকাশ করে যাচ্ছে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ১৯৪৭ সালে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে কোনো মিল না থাকার পরও শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে ১২শ’ মাইল ব্যবধানের দুটি পৃথক ভূখণ্ডকে এক করে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। অন্যদিকে শুধু ৭.২ শতাংশ মানুষ কথা বলত উর্দুতে। সেই উর্দুকেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জোর পাঁয়তারা শুরু করে।

কিন্তু বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তা হতে দেয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় দেশভাগের পরপরই কলকাতায় একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল পিছিয়ে পড়া ও নিপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা।

এর নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সময় কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে বঙ্গবন্ধু সরাসরি যুক্ত হন ভাষা আন্দোলনে। গঠিত হয় তমুদ্দিন মজলিস, এরপর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।

যখন ভাষা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণস্বাক্ষর অভিযান শুরু হয়, তখন থেকেই শেখ মুজিব এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ডিসেম্বর মাসে ১৪ জন ভাষা বীর সর্বপ্রথম ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেন।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলের তমুদ্দিন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথসভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়।

সভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, আবুল কাশেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহসহ অন্য নেতারা। সভায় রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অবিস্মরণীয় দিন। এদিন ভাষার দাবিতে প্রথম হরতাল পালিত হয়। এটাই হলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম হরতাল। হরতালের নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান।

ওইদিন তিনি পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এটি ছিল পাকিস্তানে কোনো প্রথম রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার। (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, প্রকাশক বাংলা একাডেমি)।

তবে ভাষা আন্দোলন খেমে নেই। আস্তে আস্তে তা গণআন্দোলনে রূপ নিতে থাকে, শহর থেকে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে। আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি ছিলেন ছাত্র ও তরুণেরা। তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিসম্যাটিক নেতৃত্বের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছিল।

ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে শেখ মুজিবকে আটক করে পাকিস্তান সরকার। তবে কারাগার থেকেই ওই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন তিনি।

ভাষাসৈনিক গাজীউল হক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন- ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’ (গাজীউল হক, আমার দেখা আমার লেখা, পৃষ্ঠা-৪০)।

একই কথা লিখেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।’ (তথ্যসূত্র: ভালোবাসি মাতৃভাষা- পৃষ্ঠা: ৬২)

২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাস্তায় নামেন বাংলার দামাল ছেলেরা। বাঙালি তরুণদের আত্মদান শুধু বাংলাদেশ বা বাঙালির নয়, তা এক বিশ্বজনীন ঘটনা। এরপর ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয় পাকিস্তান সরকার।

এক্ষেত্রে বলা যায়, ১৯৪৮ সালের মার্চে সীমিত পর্যায়ে যে আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে।

যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় থাকাকালে খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যে সব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কু-মতলবে করা হয়েছে। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে, এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক। ১৬ ফেরুয়ারি তারিখের আইন সভার অধিবেশননেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।’ (সূত্র: ভালোবাসি মাতৃভাষা-ভাষা-আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ-বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, মার্চ ২০০২, পৃ. ১৮২-১৯১)।

ভাষা আন্দোলনের পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলী বাংলায় চালু প্রসঙ্গে তিনি আইন সভায় গর্জে ওঠেন এবং মহানায়কের ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধুসহ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ওইদিনও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জানান তিনি।

১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। এর পেছনেও বিশেষ অবদান রয়েছে বঙ্গবন্ধুর।

ভাষা আন্দোলন- কেবল ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমিত ছিল না। একুশের উৎস থেকে জেগেছিল গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন; সে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে দানা বেঁধেছিল সংগ্রাম।

স্বাধীনতাসংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি। তেমনি একুশ আজও পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ভাষার অধিকার অর্জনেরও পথিকৃৎ হয়ে আছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলা ভাষায় সংবিধান প্রণীত করেন বঙ্গবন্ধু। এটি-ই একমাত্র দলিল যা বাংলা ভাষায় প্রণীত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রথম বাংলায় বক্তব্য দিয়ে বিশ্বসভায় বাংলাকে তুলে ধরেন।

বাংলা ভাষা আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই দেশের প্রতি তার ভালোবাসা থাকবে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

তাই ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান সরকারি কাজে বাংলাভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারি নির্দেশ জারি করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভাষা-আন্দোলনেরই সুদুর প্রসারী ফলশ্রুতি।’ (দৈনিক সংবাদ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৫)।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণী ছিল- এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলেছে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় ৪৮ বছরে এসেও আমরা এখনও সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে পারিনি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বাংলা চালু থাকলেও বাংলা এখনো উচ্চশিক্ষার বাহন হয়নি।

বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশলসহ বহু বিষয়ে বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করা সম্ভব হয়নি। ফলে এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। অথচ জাপান, কোরিয়াসহ বহু দেশ মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার সব দরজা খুলে দিয়েছে, যাদের লোকসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। আমাদের বহু ভাষাবিদ ও বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তাদের উৎসাহ দিতে হবে যেন বাংলায় পাঠ্যপুস্ত রচনা করেন।

এতে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা, গবেষণাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। আর সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার করতে পারলে আমরা বিশ্বে নিজেদের আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো।

আমরা বাংলায় কথাও বলছি। তবে হাল আমলে বাংলার বিকৃতিও হয়েছে। যা শোভনীয় নয়। কোনো কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেয়। অনেক অভিভাবক রয়েছেন যারা সন্তানকে বাংলা থেকে ইংরেজিতে কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন; এটা কাম্য নয়।

মিশ্র অর্থনীতির এই যুগে অবশ্যই বহু ভাষা জানা প্রয়োজন। তাই বলে সবার আগে নিজের ভাষাকে শুদ্ধভাবে বলতে ও লিখতে পারা গুরুত্বপূর্ণ। আর এটি-ই হতে পারে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠ উপায়। পৃথিবীর সর্বত্র সব মাতৃভাষা আপন গতিতে বিস্তার লাভ করুক-জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।

Print Friendly, PDF & Email