এখুনি ঠেকান, নয়তো কারো সন্তান রক্ষা পাবে না

প্রকাশিতঃ 10:31 am | June 04, 2021

শাহানা হুদা রঞ্জনা :

গত কয়েকদিন ধরে এমন কয়েকটি ঘটনা সামাজিক মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে ঘুরে ফিরে আসছে, বাহ্যত সেগুলোকে আলাদা আলাদা ঘটনা মনে হলেও, ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা লিংক বা সংযোগ রয়েছে। এলএসডি মাদকের ফিরে আসা, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হাফিজুলের নিজেকে কোপানো, যৌন নির্যাতনের বিকৃত ভিডিও ভাইরাল, টিকটকের বিস্তার – এই সব ঘটনাগুলোর উৎস সব একই।

সামাজিক বিপর্যয় ও আবেগ বিবর্জিত মানসিকতা থেকে এর সৃষ্টি। অস্থিরতা, লক্ষ্যহীন জীবন, হতাশা, মাদক, বিকৃত রুচির চর্চা, দুর্নীতি, দুর্বল আইনী কাঠামো, পর্ণোগ্রফি এবং সামাজিক মাধ্যমের অসামাজিক ব্যবহার তরুণদের এমন পরিণতির জন্য দায়ী।

সমাজের সবস্তরে এই বয়সী ছেলেমেয়েরা একই ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, অশ্লীল মন্তব্য, বিভিন্ন কায়দায় সেক্স করা, বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করা, পর্ণোনায়িকার মতো করে মেয়ে বান্ধবীর কাছ থেকে সাড়া পাওয়ার চেষ্টা- এসবই ঘটছে নিয়মিত। এদের এই অস্বাভাবিক যৌন আচরণের সাথে যোগ হয়েছে মাদক ও পর্ণোগ্রাফি।

গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবিতে দেখালো কয়েকজন তরুণকে এলএসডি সম্পৃক্ততার কারণে যখন পুলিশ ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছে, ছেলেগুলো সবাই হাসছে। ওদের চলাফেরা, কথা বলায় অপরাধীর কোন ছাপ নেই। হয় ওরা এইসব অপরাধকে ধর্তব্যের মধ্যে আনছে না, অথবা মনে করছে তাদের কোন বিচার হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এইসব স্মার্ট তরুণরা কীভাবে একটি নষ্ট সমাজের অংশীদার হতে চলেছে, একজন অভিভাবক হিসেবে ভাবতেও ভয় হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে।

আমাদের দেশে সব তরুণ-তরুণী যে এমন, তা নয়। বরং অধিকাংশই ভালো কাজের সাথে জড়িত। কেউ পড়ছে, কেউ খেলছে, বেড়াচ্ছে, গান গাইছে, আবিষ্কার করছে, ব্যবসা করছে, বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে এবং সবচাইতে বড় কথা পরিবারকে সাথে নিয়ে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে অর্থলোভী নষ্ট মানুষদের খপ্পরে পড়ে আমাদেরই অনেক সন্তান বিপথে যাচ্ছে। এরা চারিদিকে ওৎ পেতে থেকে সমাজকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এদেরই একজন টিকটক বাবু বা টিকটক হৃদয়। এদের ক্ষমতা এতোই বেশি যে এরা সমাজে নানাধরনের বিকৃতি ছড়িয়ে দিতে পারছে অনায়াসে। আমাদের চারদিকটা যেন টিকটক হৃদয়ের হাতে জিম্মি।

শুধু কি তরুণরাই অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ছে, তারাই কি ভার্চুয়াল জগতে অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে? তারাই কি নারীকে কদর্যভাবে হেনস্তা করছে? উত্তর হবে না। আমরা কি ভুলে গেলাম ‘গ্যাং কালচার’ এবং এর জের ধরে বীভৎস কায়দায় কিশোর আদনানকে হত্যার খবরটি। এলাকার দখল নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাত, বন্ধুকে মেরে ফেলা, মারার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া!

এ ধরনের ভয়াবহ অপরাধ করার কথা আমরা ভাবতে না পারলেও আমাদের সন্তানরা অনায়াসে এগুলো করছে। উত্তরাতে নাইন স্টার ও ডিসকো বয়েজ নামে যে গ্রুপগুলো এইসব কাজ করেছিল তাদের সদস্যদের সবার বয়সই ১৪ থেকে ১৮ এর মধ্যে। এদের বেশিরভাগই উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। নেতৃত্বে আছে নিম্নবিত্ত ঘরের পড়াশোনা না জানা কিশোররা। দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত, স্বচ্ছল ও ধনী পরিবারের বেপরোয়া বা বখাটে সন্তানেরা চালিত হচ্ছে সমাজের বঞ্চিত পরিবারের লেখাপড়া না করা মাস্তান ছেলেদের দ্বারা।

বিভিন্ন অপরাধের সাথে শিশু কিশোর ও তরুণদের ক্রমবর্ধমান সংশ্লিষ্ট হওয়ার হার যে উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে, এটা কিন্তু খুব সাম্প্রতিক কোন ঘটনা নয়। অনেকদিন ধরেই বাড়ছে কিন্তু আমরা নজর দেইনি এবং এখনও দিচ্ছি না। বহুবার পত্রপত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছে যে পথশিশু ও কিশোররা না বুঝেই বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে।

এসবের পেছনে কাজ করছে অপরাধীদের সংঘবদ্ধ চক্র। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন অপরাধী চক্র নিজেদের স্বার্থেই অপরাধের সঙ্গে শিশু কিশোরদের জড়িত করছে এবং এই হার দিন দিন বাড়ছে। মাদক ব্যবহারের মাধ্যমে এরা নিজেরাই অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এখন শুধু দারিদ্রের কারণে নয়, অন্যান্য অনেক কারণেই তরুণ-তরুণীরা অপরাধী হয়ে উঠছে। সচ্ছল পরিবারের বাবা মায়েরা তাদের ব্যস্ততা ও অসচেতনতার কারণে পারছেন না সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে, তাদের যত্ন নিতে, তাদের কাজকর্মের প্রতি দৃষ্টি দিতে এবং পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বজায় রাখার মত শিক্ষা দিতে।

আর ব্যক্তিগতভাবে সময় দিতে না পারার এই ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে সন্তানের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে অপরিমিত অর্থ, প্রাচুর্য এবং যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা, যা সন্তানকে করে তোলে বেপরোয়া, দুর্বিনীত ও অপরাধী। সেইসব বখে যাওয়া সন্তানরা যেমন সহজে এই মন্দ পথে পা বাড়ায়, তেমনি দাগী অপরাধীরাও খুব সহজে তাদের ব্যবহার করার সুযোগ পায়।

বাবা মায়ের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ ও জীবনযাপন, কুশিক্ষা, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অপরাধ করার প্রবণতা সচ্ছল ও অসচ্ছল দুই পরিবারের সন্তানকে বিপদের মুখে ফেলে দেয়। দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকরা নিজেরাই এতটা হতাশা, বিপদগ্রস্ত ও জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে থাকেন যে সন্তানের নৈতিকতা নিয়ে ভাবার সময় বা সুযোগ কোনটাই তাদের নেই।

তবে ধনী ও সচ্ছল পরিবারের চিত্র কিন্তু ভিন্ন। এখানে অভিভাবক সন্তানকে সময় দেয়ার পরিবর্তে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে বেশি উৎসাহী থাকেন। তারা মনে করেন এটাই যথেষ্ট প্যারেন্টিং। কিন্তু আদতে ব্যাপারটা সেরকম নয়। আর তাই শিশু কিশোর ও তরুণদের হাতে থাকা গাড়ি, মোটরসাইকেল, দামী ফোন, ঘড়ি, জামা কাপড় সবই ব্যবহৃত হচ্ছে অপরাধ কার্যক্রমের সাথে।

সচ্ছল ও ধনী পরিবারের শিশু কিশোররা যখন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কিছু পায়, অথচ সময় কাটানোর কোন গঠনমূলক উপায় খুঁজে পায়না, যখন তারা দেখে যে তাদের কাজের বা আচরণের জন্য কোথাও কোন জবাবদিহিতা নেই, যখন তারা দেখে চারপাশে তাদের জন্য সময় দেয়ার কেউ নেই, তাদের অভিভাবক অসৎ পথে টাকা আয় করছে, পড়াশোনা না করে বা কাজকর্ম না করেও সব পাওয়া যায়, তখন তারা খুব সহজেই এমন বিপদজনক পথে পা বাড়ায়। এরা বুঝতেই পারেনা এই পথে সহজে ঢোকা গেলেও, বের হওয়া কঠিন।

প্রতিদিন খবরে যেসব অপরাধের কাহিনী আসছে, এর প্রায় প্রতিটির সাথে তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী, যৌনতা, প্রযুক্তির অপব্যবহার ও মাদক জড়িত। সমাজের সবস্তরে এই বয়সী ছেলেমেয়েরা একই ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, অশ্লীল মন্তব্য, বিভিন্ন কায়দায় সেক্স করা, বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করা, পর্ণোনায়িকার মতো করে মেয়ে বান্ধবীর কাছ থেকে সাড়া পাওয়ার চেষ্টা- এসবই ঘটছে নিয়মিত। এদের এই অস্বাভাবিক যৌন আচরণের সাথে যোগ হয়েছে মাদক ও পর্ণোগ্রাফি।

যদিও পর্ণোগ্রাফি বা সেক্স ভিডিও নতুন কোন বিষয় নয়। তবে যতো দিন যাচ্ছে পর্ণোগ্রাফির সেইসব ভিডিওই সাড়া ফেলছে, যেগুলো অস্বাভাবিক ও চরম নোংরা। যেমন এই টিকটক হৃদয় বাবু ও তার দল যেভাবে একটি বাংলাদেশী মেয়েকে যৌন নির্যাতন করেছে তা অকল্পনীয়। এরা নারী পাচারকারী দলের সাথে জড়িত। এরা মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করে এবং পরে ব্ল্যাকমেইল করে মেয়েগুলোকে বিদেশে বিক্রি করে দেয়। এর আগে তারা হিংস্র কায়দায় যৌন নির্যাতন করে সেই ভিডিও ভাইরাল করেছে এবং সেই ভিডিওটি বেশ বাজার পেয়েছে। এরকম আরো সংঘবদ্ধ দল আরো আছে।

বেগমগঞ্জের গৃহবধূকে আটকে রেখে গণধর্ষণ করে যারা ভিডিওটি বাজারে ছেড়েছিল, তাদের সেই ভিডিওটিও বিকৃতরুচির কিছু অমানুষের হাতে হাতে ঘুরেছে। এরা চায় এর চেয়েও নোংরা এবং ভয়াবহ ভিডিও। এর মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে আমাদের তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ টিকটক হৃদয়ের পথেই হাঁটছে।

অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। তরুণ-তরুণীরা যে গতিতে ভাঙনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা তা ধারণাও করতে পারছি না। অভিভাবক, আইন-শৃংখলা বাহিনী, শিক্ষক সমাজ, সুশীল সমাজ , সমাজের মোড়ল, শিশু কিশোর সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং সরকারের করণীয় কী, তা এখুনি ভাবতে হবে। আমরা প্রযুক্তিকে অস্বীকার করতে পারবো না কিন্তু টিকটক হৃদয় বাবু, মাদক ও পর্ণোগ্রফির যত্রতত্র ব্যবহার ঠেকাতে হবেই। নতুবা আপনার আমার কারো সন্তান এই আগুনের আঁচ থেকে রক্ষা পাবে না।

লেখক : সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

Print Friendly, PDF & Email