উন্নত বিশ্বের আদলে আধুনিক সক্ষমতায় ফায়ার সার্ভিস

প্রকাশিতঃ 10:34 am | February 23, 2021

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি ব্যস্তময় ও চ্যালেঞ্জিং মুহুর্ত পার করছে ফায়ার সার্ভিস। বর্তমানে অগ্নিকাণ্ড এক মূর্তিমান উদ্বেগ। প্রতিনিয়তই কোথাও না কোথাও অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। আর এসব ঘটনায় নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।

অগ্নিকাণ্ড থেকে দ্রুত উদ্ধার ও ক্ষয়ক্ষতি কমানোর উদ্দেশে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সকে আরও শক্তিশালী ও আধুনিক করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।উন্নত বিশ্বের আদলে সাজানো বর্তমান ফায়ার সার্ভিস ইতোমধ্যেই পেয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়াও। বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে সক্ষমতা। দেশের সার্বিক উন্নয়নে ফায়ার সার্ভিসকে আরও আধুনিক করতে চায় সরকার। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, ইরান, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ন্যায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিতে সমৃদ্ধ করা হয়েছে সেবাধর্মী এ প্রতিষ্ঠানটিকে।

প্রতি উপজেলায় ফায়ার স্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি ১১টি আধুনিক ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন স্থাপনের প্রকল্প চলমান রয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে সারা দেশে প্রায় ৭০০টি ফায়ার স্টেশন স্থাপন হবে বলেও জানা গেছে। বর্তমানে ২০তলা পর্যন্ত উঁচু ভবনে অগ্নিনির্বাপণে কাজ করার মতো যন্ত্রপাতি ও সক্ষমতাও অর্জন করেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গতি, সেবা ও ত্যাগের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত ও প্রথম সাড়া প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে এ বিভাগের কর্মীরা অগ্নিনির্বাপণ, অগ্নি প্রতিরোধ, উদ্ধার, আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান, মুমূর্ষু রোগীদের হাসপাতালে প্রেরণ ও দেশি-বিদেশি ভিআইপিদের অগ্নি নিরাপত্তা দিয়ে আসছে।

ফায়ার সার্ভিসসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি উপজেলায় ফায়ারস্টেশন স্থাপনের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বর্তমানে ৪৫৬টি ফায়ারস্টেশন চালু রয়েছে, কর্মরত রয়েছে ১০ হাজার ৯২৬ জন এবং ফায়ার সার্ভিস কল্যাণ ট্রাস্টও গঠন করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে (তিন বছরের) অর্জন হিসেবে ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ৯৯৯-এর আওতায় ৩৮ হাজার ১৫৭টি কলে সাড়া প্রদান করেছে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর। জঙ্গিবিরোধী যৌথ অভিযান এবং অগ্নি নির্বাপণ কাজেও অংশগ্রহণ করে শাহাদাতবরণ করেছেন ফায়ারম্যান আ. মতিন (২০১৭) ও সোহেল রানা (২১০৯)। ৫৩ হাজার ৭৭৬ জনকে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া মহাসড়কগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ ৮৮টি পয়েন্টে টহল ডিউটি পরিচালনা করা হচ্ছে।

একই সময়ে ৬২ হাজার ৫২৬টি অগ্নিকাণ্ড নির্বাপণ করে ৫ হাজার ৮৭১ কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা ও ২৯ হাজার ৬৭টি দুর্ঘটনায় অংশ নিয়ে ৪৩ হাজার ৫৭২ জন জীবিত এবং ৬ হাজার ১৬৭ জনকে মৃত উদ্ধার করেছে। চকবাজার, চূড়িহাট্টা ওয়াহিদ মার্কেট, এফআর টাওয়ার, নারায়ণগঞ্জ বিআইডব্লিউটিএয়ের গোডাউন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, গুলশান ডিএনসিসি ও খিলগাঁও রেলগেইট কাঁচাবাজার এবং ভাষানটেক বস্তিসহ অন্যান্য দুর্ঘটনাও মোকাবিলায়ও সফল হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের প্রণোদনা প্রদানের উদ্দেশ্যে ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৭৮ জনকে পদক প্রদান, ৪৭৮ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীকে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পাঁচটি পদের বেতনগ্রেড ও বেতনস্কেল দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে।

ফায়ারম্যান পদবি পরিবর্তন করে ফায়ার ফাইটার নামকরণ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। শুধু তাই নয়— একই সময়ে তিনটি জাম্বু কুশন, ৬৮৯ কোটি টাকার আধুনিক সাজসরঞ্জামাদিও সংগ্রহ করেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সেফটি ম্যানেজার কোর্স চালু করে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩৪২ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান, ৭ হাজার ৭৬৬টি অগ্নি নির্বাপণী প্রশিক্ষণ ও দুই হাজার ৮০৩টি অগ্নি নির্বাপণী মহড়া আয়োজনসহ ৯ হাজার ২৯১ জন কমিউনিটি ভলান্টিয়ার প্রস্তুত ও তিন হাজার ১১৯ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রশিক্ষণ প্রদান, ১১ হাজার ৭৮১ ভবনের অগ্নি নিরাপত্তাব্যবস্থা সার্ভে করে সার্ভের ফলাফল সংশ্লিষ্টদের প্রেরণ ও ২৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতেও সমর্থ হয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

সারা দেশে এ বিভাগের সার্বিক কার্যক্রমে গতিশীলতা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেও নিজস্ব ওয়েবসাইট ছাড়াও ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার ও তথ্য সেল চালুসহ নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর।

জানা গেছে, সফলতার সঙ্গে পথচলায় ফায়ার সার্ভিসকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল দোকান-গোডাউন স্থাপন, অগ্নি নির্বাপণের জন্য শহর এলাকায় পানির স্বল্পতা, হাইড্রেট সিস্টেমের অভাব, ইনবিল্ট ফায়ার ফাইটিং ফ্যাসিলিটিজ স্বল্পতা, ট্রাফিক জ্যাম, রাস্তাঘাটের অপ্রতুলতা, অপ্রশস্ত রাস্তা এবং জনসচেতনতার অভাবজনিত কারণে দুর্যোগে সাড়া প্রদান করে সময়মতো দুর্ঘটনা মোকাবিলা ও উদ্ধার কাজ পরিচালনা অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চ্যালেঞ্জ যতোই থাকুক না কেন, ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের আওতায় বাস্তবায়নাধীন পাঁচটি প্রকল্পের সম্পন্নকরণ, ৬২ হাজার কমিউনিটি ভলান্টিয়ার তৈরি, গ্যাপ এরিয়ায় ফায়ারস্টেশন নির্মাণ করে সাড়া প্রদানের সময় হ্রাসকরণ, ডুবুরি ইউনিট সম্প্রসারণ, ১০টি বিশেষায়িত অগ্নি নির্বাপণ ও উদ্ধার ইউনিট স্থাপন, জাইকা ও কইকার সহায়তায় আধুনিক হেডকোয়ার্টার ও ই ও সি স্থাপন, আধুনিক ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ পরিচালনার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি স্থাপন, অ্যাম্বুলেন্স সেবার সম্প্রসারণ, প্রতিটি বিভাগে বিভাগীয় সদর দপ্তরসহ ওয়ার্কশপ ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন স্থাপন, স্যাটেলাইট ফায়ার স্টেশন স্থাপন, অর্গানোগ্রাম যুগোপযোগী করার পরিকল্পনা নিয়েই অদম্য গতিতে এগিয়ে চলছে ফায়ার সার্ভিস।

এর মধ্য দিয়ে চলতি অর্থবছরে অগ্নিসহ অন্যান্য দুর্ঘটনায় শতভাগ সাড়া প্রদান, ১৪ হাজার জন রোগী-আহত ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদান, অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে চার হাজার চারশটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন, ১ হাজার ৭০০ প্রতিষ্ঠানে সার্ভে পরিচালনা, ১২ হাজার মালগুদাম ও কারখানার জন্য ফায়ার লাইসেন্স ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিকরণে ৭ হাজার ৭৫০টি অগ্নি নির্বাপণী মহড়া, ১৩ হাজার টপোগ্রাফি, জন ও গণসংযোগ পরিচালনা এবং এক লাখ ৩৩ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ প্রদানের টার্গেট নিয়ে সার্বিক কার্যক্রমের বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর। এছাড়া সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে ডুবুরি ইউনিটের সম্প্রসারণ, ৬০০ জন কমিউনিটি ভলান্টিয়ারকে প্রশিক্ষণ প্রদান, নতুন ফায়ারস্টেশন স্থাপনের জন্যও ৮৬টি নতুন ফায়ারস্টেশনের পূর্তকাজ সম্পন্ন ও সাতটি জমি অধিগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেই কাজ করছে সংস্থাটি।

কালের আলো/ডিএসবি/এমএইচএ

Print Friendly, PDF & Email