সিন্ডিকেটের রাহুমুক্ত হচ্ছে ছাত্রলীগ, কারা হচ্ছেন নতুন ‘কান্ডারী’

প্রকাশিতঃ 11:17 am | January 11, 2018

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস.এম.জাকির হোসাইনকে রীতিমতো অবাক করে দিয়ে ছাত্রলীগের ২৯ তম জাতীয় সম্মেলনের দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়েছে। আগামী ৩১ মার্চ এ সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব যাচাই-বাছাইয়ে ইতোমধ্যে সাবেক তিন ছাত্র নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছে কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড। ছাত্রলীগের রাজনীতিকে মূলত বিশেষ সিন্ডিকেটের রাহুমুক্ত করতেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে দলীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এদিকে, দেশের প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্র সংগঠনটির নতুন ‘কান্ডারী’ হয়ে কারা কারা আসছেন, তা নিয়ে এরই মধ্যেই ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে সব মহলেই। তবে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনে এখনো পর্যন্ত বয়সের বিষয়টি চূড়ান্ত না হওয়ায় নেতা-কর্মীদের মাঝে এক ধরণের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।

ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণকারী অদৃশ্য সিন্ডিকেট চাচ্ছে ২৭ বয়সসীমার আওয়াজ তুলে সিনিয়রদের কৌশলে নেতৃত্ব থেকে মাইনাস করে দেয়া। তবে দলটির সাবেক ছাত্র নেতাদের বড় একটি অংশ মনে করেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের ফসল ঘরে তুলতে রাজপথের ‘ভ্যানগার্ড’ সংগঠনটির নেতৃত্বের বয়সসীমা থাকবে ২৯।

অতীতের তিনটি কমিটির বেলাতেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই বছর বাড়িয়ে বয়সসীমা ২৯ করে দিয়েছিলেন। যদিও সবকিছুই নির্ভর করছে দলীয় সভানেত্রীর মনোভাবের ওপর।

জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৬ ও ২৭ জুলাই ছাত্রলীগের ২৮ তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে সাইফুর রহমান সোহাগকে সভাপতি ও এস এম জাকির হোসাইনকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। গঠনতন্ত্র মোতাবেক মেয়াদোত্তীর্ণ এ কমিটি ভেঙে দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্মেলন দাবিতে কঠোর আন্দোলনে নামেন কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ। ওই অংশের নেতা-কর্মীরা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিলাসী জীবনের পাশাপাশি নানা নেতিবাচক কর্মকান্ডের সমালোচনায় মুখর ছিলেন।

এ অবস্থায় ক’দিন আগে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে না জানিয়ে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর র‌্যালীর আগের আলোচনা সভায় পরবর্তী সম্মেলনের ঘোষণা দেন দলীয় সাধারণ সম্পাদক ও সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দলীয় দ্বিতীয় শীর্ষ প্রধানের এমন ঘোষণায় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও তাদের অনুসারীরা আশাহত ও বিমর্ষ হলেও সম্মেলন দাবিতে সোচ্চার নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। উচ্ছ্বাসের এ ঢেউ লাগে দলের তৃণমূলের কর্মীদের মাঝেও।

সূত্র মতে, ছাত্রলীগের রাজনীতিতে বহুল উচ্চারিত ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটিকে এবার পুরোপুরি মুছে দিতে চায় দলীয় হাইকমান্ড। ওই বিশেষ সিন্ডিকেটের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে খবরদারিতেও হাইকমান্ড রীতিমতো বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট। ফলে এবার সিন্ডিকেটের যবনিকাপাত ঘটাতেই সংগঠনের বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই নতুন সম্মেলনের ঘোষণা এসেছে, এমন আলাপচারিতা চলছে নেতা-কর্মীদের আড্ডায়।

এমনকি ২৯ তম জাতীয় সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব বাছাইয়ের আগে এটি ওই বিশেষ সিন্ডিকেটের জন্য এক ধরণের ‘সতর্ক বার্তা’ বলেই মনে করছেন অনেকেই।

দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড চাচ্ছে যোগ্যতার মাপকাঠিতেই পরবর্তী নেতৃত্ব নির্বাচন করতে। এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীমের নেতৃত্বে সাবেক ৩ ছাত্র নেতাকে সমন্বয়ের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যরা হলেন- আ’লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেন এবং ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মারুফা আক্তার পপি। তারা পরবর্তী নেতৃত্ব যাচাই-বাছাই করবেন। তবে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ‘মুকুট’ কার মাথায় উঠবে সেটি নির্ধারণ করবেন দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সূত্র মতে, দায়িত্বপ্রাপ্ত ৩ নেতার সঙ্গে বিশেষ সিন্ডিকেটের প্রধানের বরাবরই দূরত্ব ছিল। এবার নেতৃত্ব নির্ধারণের খেলায় সিন্ডিকেট প্রধান আগে থেকেই ‘আউট’ হয়ে যাওয়ায় সাম্রাজ্য হারানোর শঙ্কা নিয়েই নতুন পরিকল্পনা ও মিশন নিয়ে তিনি মাঠে নামছেন,এমন গুঞ্জণও চলছে দলীয় পরিমন্ডলে।

তাদের ভাষ্যে, এরই প্রথম ধাপ হিসেবে সিন্ডিকেট ২৭ বয়সসীমা ও ‘আইওয়াশ ভোটিং’র আওয়াজ তুলছে। প্রায় প্রতিটি ইউনিটেই তাদের অনুসারী-অনুগামীরা নেতৃত্বে থাকায় সিন্ডিকেট এ মিশন সামনে নিয়েই এগুচ্ছে, এমন কথাবার্তাও দলীয় নেতা-কর্মীদের মুখে মুখে।

তবে সংগঠনের সাবেক ছাত্র নেতাদের বড় একটি অংশের মনোভাব হচ্ছে অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ ও সিনিয়র এবং জুনিয়রের মিশেলে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা। একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার নিরঙ্কুশ বিজয় সুনিশ্চিত করতে মাঠে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্যই তাঁরা অভিজ্ঞদের নেতৃত্বে বসানোর পক্ষে।

২৯ তম জাতীয় সম্মেলনে সংগঠনের শীর্ষ দুই পদের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুল পাঠান সেতু, শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, ত্রাণ সম্পাদক ইয়াজ আল রিয়াদ, আইন সম্পাদক আল নাহিয়ান খান জয়, কৃষি সম্পাদক বরকত হাওলাদার, কর্মসূচি সম্পাদক রাকিব হোসেন, পরিবেশ সম্পাদক হাবিবুল্লাহ বিপ্লব, বিজ্ঞান সম্পাদক আনোয়ার পারভেজ আরেফিন ও অমর একুশে হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এহসান পিয়াল।

এর মধ্যে ২০১৩ সালের দিকে সরকার হটাতে বিএনপি-জামায়াত জোটের আগুন সন্ত্রাসের সময় জীবনবাজি রেখে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে রাজপথে রুখে দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুল পাঠান সেতু। ওই সময় নাশকতা বিরোধীদের ‘দবল ধোলাই’ করতেও করিৎকর্মা ছিলেন এ নেতা। ফলে তাকে ঘিরে নেতৃত্বের স্বপ্ন বুনছেন দলটির বেশিরভাগ নেতা-কর্মীই।

ছাত্রলীগ নেতা গোলাম রব্বানী ও ইয়াজ আল রিয়াদ দলীয় স্বচ্ছ ইমেজধারী নেতা হিসেবেই পরিচিত। যুবদলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মোকাবেলা করা নেতাদের সামনের সারিতেই ছিলেন কৃষি সম্পাদক বরকত হাওলাদার।

সব মিলিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভালো বক্তা, সংগঠক, মেধাবী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা আছে এমন কারো হাতেই তুলে দেয়া হতে পারে ছাত্রলীগের পরবর্তী নেতৃত্ব এমন আভাসই মিলেছে।

Print Friendly, PDF & Email