রাজস্ব বাড়াতে এনবিআরের বিশেষ উদ্যোগ

প্রকাশিতঃ 9:49 am | September 08, 2020

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

রাজস্ব আহরণ বাড়াতে বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। শুল্ক আদায়ে কয়েক বছর আগে ইলেকট্রনিক পেমেন্ট (ই-পেমেন্ট) ব্যবস্থা চালু করলেও কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছে না। তাই রাজস্ব ফাকি রোধে ই-পেমেন্ট বাধ্যতামূলক করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি আদেশ জারি করেছে এনবিআর।

আদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আগামী ১ এপ্রিলের মধ্যে থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারির মধ্যে ধাপে ধাপে ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক কার্যকর করতে বলা হয়েছে। কারণ আধুুনিক ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করে ঝুঁকিবিহীনভাবে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব বলে সূত্র জানায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুল্ক কর, ফি ও চার্জ পরিশোধে ২০১৭ সালে রিয়াল টাইম গ্রোস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস) ব্যবহার করে ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করে এনবিআর। ৪১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক এই ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু বাধ্যতামূলক না হওয়ায় এর কাঙ্ক্ষিত সুফল এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।

অপরদিকে ব্যবহাকারীর সংখ্যা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শুল্ক-কর পরিশোধের এ আধুনিক পদ্ধতির সেবা থেকে আমদানিকারকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, এই পদ্ধতিটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় জাল চালান দাখিল ও মহা-হিসাব নিরীক্ষক এবং নিয়ন্ত্রক অফিসের সাথে প্রদর্শিত রাজস্ব আহরণ চিত্রে প্রায়ই গরমিল দেখা যায়।

অন্যদিকে আমদানিকারকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা অর্থ রাজস্ব হিসেবে জমা দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষে জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করে কম রাজস্ব জমা করে বেশি রাজস্ব জমার জাল দলিল প্রস্তুত করারও আশঙ্কা থেকে যায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ই-পেমেন্টের মাধ্যমে শুল্ক রাজস্ব জমা হয়েছে এক হাজার ১৩০ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

আর গত অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত জমা হয়েছে চার হাজার ১১০ কোটি টাকা। যেখানে প্রতি অর্থবছরে বাজেটে বিশাল আকারের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু বিভিন্ন ফাঁকফোকরের কারণে তা আদায় হচ্ছে না। অথচ আধুুনিক এই ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করে জাল-জালিয়াতির ঝুঁকিবিহীনভাবে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব।

এই অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে দায়িত্ব নিয়েই সিনিয়র সচিব এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম উদ্যোগ নেন ই-পেমেন্ট বাধ্যতামূলক করার। গত ১৮ মার্চ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভার আয়োজন করেন তিনি।

সভায় আমদানি-রপ্তানিকারক এবং এজেন্টদেরকে সচেতন করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন বা বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার মাধ্যমে কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে বলে সদস্য কাস্টমস নিরীক্ষা, আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সদস্য, কাস্টমস নীতি ও আইটি এবং সব কাস্টম হাউসের কমিশনারদের দায়িত্ব দেয়া হয়।

একই সাথে ওই সভায় কমলাপুর কাস্টম হাউস (আইসিটি) ন্যূনতম শুল্ক করের একটি পরিসীমা নির্ধারণ করে তা ই-পেমেন্টের আওতায় আনার জন্য পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন (পাইলটিং) সম্পন্ন করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে জনসমাগম নিরুৎসাহিত করার কারণে সচেতনতামূলক কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। তবে সংক্ষিপ্ত ভিডিও টিউটোরিয়াল নির্মাণের কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

বিদ্যমান বাস্তবতায় ধাপেধাপে ই-পেমেন্ট বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে গত ৩১ আগষ্ট কাস্টমস নিরীক্ষা, আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সদস্য খন্দকার মুহাম্মদ আমিনুর রহমান প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে অফিস আদেশ জারি করেছেন।

তাতে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের কারণে কাস্টম হাউস ও অন্যান্য দপ্তরে জনসমাগম কমিয়ে রাজস্ব ফাঁকি নিয়ন্ত্রণ এবং কাস্টমস কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে কাস্টম হাউস ও কাস্টমস স্টেশনে ই-পেমেন্ট চালুর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বিভিন্ন ধাপে তা বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম ধাপ হচ্ছে-ছয়টি কাস্টম হাউস ও বিভিন্ন কাস্টমস স্টেশনে ই-পেমেন্ট বিষয়ে অংশীজনদের সাথে জনসমাগম পরিহার করে মতবিনিময় সভা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অ্যাসাইকুডা টিম সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউস ও কাস্টমস স্টেশনে প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা পাঠাতে হবে। তয় ধাপ হচ্ছে- যে সব ব্যাংকে ই-পেমেন্টের ব্যবস্থা রয়েছে সে সব ব্যাংক গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণামূলক কার্যক্রম গ্রহণে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

চতুর্থ ধাপ হচ্ছে— ঢাকা কাস্টম হাউস ও আইসিডি কাস্টম হাউস এফবিসিসিআইর সাথে আলোচনা করে ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ওই নির্দেশনা আরও বলা হয়েছে-২০২১ সালের ১ এপ্রিলের মধ্যে কমলাপুর আইসিডি কাস্টম হাউসে সব বিল এন্ট্রি এবং বিল অব এক্সপোর্টে রাজস্ব আবশ্যিকভাবে ই-পেমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে কমিশনারকে ক্ষমতাবলে অফিস আদেশ জারি করতে হবে।

২০২১ সালের ১ জুলাইয়ের মধ্যে সব কাস্টম হাউস এবং কাস্টমস স্টেশনে দুই লাখ টাকার বেশি রাজস্ব সংশ্লিষ্ট পণ্য চালানের শুল্ক আবশ্যিকভাবে ই-পেমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট কমিশনারকে ক্ষমতাবলে এর আদেশ জারি করতে হবে। ২০২২ সালে ১ জানুয়ারির মধ্যে দেশের সব কাস্টম হাউস এবং কাস্টমস স্টেশনে সব পণ্য চালানের রাজস্ব আবশ্যিকভাবে ই-পেমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কমিশনারকে ক্ষমতাবলে এর আদেশ জারি করতে হবে বলে বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। যেখানে এনবিআরের লক্ষ্য ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের নির্ধারিত আয়ের মধ্যে এক লাখ তিন হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা আসবে আয়, মুনাফা এবং মূলধন কর থেকে।

এক লাখ ২৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা আসবে ভ্যাট থেকে। সম্পূরক কর থেকে ৫৭ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা, আমদানি শুল্ক ৩৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক ৫৫ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে আসবে তিন হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর থেকে এক হাজার ৫৩০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

কালের আলো/এসবি/এনএল

Print Friendly, PDF & Email