প্রধানমন্ত্রীর ‘দূরদর্শী’ দিকনির্দেশনা; ‘টার্গেট’ রুখে দিলেন সেনা ও পুলিশ প্রধান

প্রকাশিতঃ 7:56 am | August 07, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো.রাশেদ হত্যাকান্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর ‘অপচেষ্টা’ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল।

নিজেদের মিশন বাস্তবায়নে বিদেশ থেকেও প্রতিনিয়তই ছড়ানো হচ্ছিল নানামুখী গুজব। পর্দার অন্তরাল থেকে কলকাঠি নেড়ে ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ডের সূক্ষ্ম পরিকল্পনার জালও বোনা হয়েছিল।

কিন্তু সব প্রচেষ্টাই পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত হালে পানি পায়নি ‘টেকনাফ ষড়যন্ত্র’। বিস্ফোরণমুখ পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি।

উল্টো হত্যাকান্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা, প্রাথমিক শাস্তি হিসেবে তাৎক্ষণিক জড়িতদের প্রত্যাহার, গ্রেফতারি পরোনায়া ও আইনের আওতায় আনা, উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন, সিনহার মায়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ ফোনালাপ সবকিছুই চলেছে সমানতালে।

সেনাপ্রধান ও পুলিশ প্রধানের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নিজ নিজ বাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান, তদন্ত কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে যৌথ টহলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন-এসবই মূলত ভেঙে দিয়েছে ষড়যন্ত্রকারী অশুভ শক্তির ‘বিষদাঁত’ ।

কঠিন এসবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ও দূরদর্শী দিকনির্দেশনায়।

সরকার প্রধানের নির্দেশেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.বেনজীর আহমেদের সম্মিলিত যুগান্তকারী প্রতিটি পদক্ষেপ পাকিস্তানি ধারার চক্রটির সেইসব ‘টার্গেট’ রুখে দিয়েছে।

সেনাপ্রধান নিজেও অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা’র মাকে আবেগঘন একটি চিঠি দিয়েছেন।

হত্যাকান্ডের পর থেকে অদ্যাবধি- পুরো বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজেই সার্বক্ষণিক মনিটরিং করেছেন। ফলে সিনহা হত্যাকান্ডের বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রিতার ঘটনা যেমন ঘটেনি তেমনি জড়িতদের বিরুদ্ধেও কঠোর অ্যাকশন নিশ্চিত হওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্ষোভও দ্রুতই প্রশমিত হয়েছে।

দাবার পাশা উল্টে ষড়যন্ত্রকারীদের নিশ্চিহ্ন করার পাশাপাশি কাগজে-কলমেও মোক্ষম এক জবাবও দিয়েছেন দেশপ্রেমিক দুই বাহিনী প্রধান।

ছুঁতোয় বিলীন হবার নয় সেনা-পুলিশ সম্পর্ক
বিশ্লেষকরা বলছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সুমহান প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠা সেনাবাহিনী ও পুলিশের দীর্ঘ ৫০ বছরের শেকড়ের সম্পর্ক একটি অনাকাঙ্খিত, দু:খজনক ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার ছুঁতোয় বিলীন হবার নয় মোটেও। সেই বিষয়টিরই ইঙ্গিত দিয়েছেন সেনা ও পুলিশ প্রধান।

নিজেদের নেতৃত্বাধীন দেশপ্রেমিক দু’টি বাহিনীর সম্পর্ক যে অটুট বন্ধনে তৈরি, রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিটি কর্মকান্ডে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের অগ্নিশিখা ভেতরে জ্বালিয়ে সব মলিনতা মুছে মাটির টানে, শেকড়ের সন্ধানেই তাদের পথচলা এসব বিষয়ও নিশ্চিত করেছেন দুই বাহিনী প্রধান।

বুধবার (০৫ আগষ্ট) দুপুরে কক্সবাজারের সেনাবাহিনীর বাংলো জলতরঙ্গে সেনা ও পুলিশ প্রধানের যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনাকে পুঁজি করে কেউ যেন পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা না করে- সেই সম্পর্কে সবিশেষ গুরুত্বপূূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন জেনারেল আজিজ আহমেদ ও ড.বেনজীর আহমেদ।

তাদের সেই বক্তব্য জনমনে প্রশংসিতও হয়েছে। দেশের স্বাধীনতার ৪৯ বছরের মাথায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর প্রধানের এই যৌথ সংবাদ সম্মেলনকে দেশের সাধারণ ও সচেতন মানুষ অনেক ইতিবাচক এবং তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন।

সেনাবাহিনী ও পুলিশের পক্ষ থেকেও বেশ জোর দিয়েই বলা হয়েছে, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা’র ঘটনাটিই যেন দেশের ইতিহাসে দুই বাহিনীর শেষ ঘটনা হয়।

ভবিষ্যতে যেন এরকম ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে লক্ষ্যেই নিজেদের ভাতৃত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় করার পাশাপাশি সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

পর্যবেক্ষক মহলের ভাষ্য
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বুধবার (০৫ আগষ্ট) দুপুরের দুই বাহিনীর প্রধানের সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা’র ঘটনার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীরা নৈরাজ্য সৃষ্টির মতোই ভয়াবহ নীল নকশার ছক প্রস্তুত করেছিল। চোখকান তীক্ষ্নভাবে খোলা রাখলে এর কিছু আলামতও খুঁজে পাওয়া যায়।

এসব ষড়যন্ত্রের ছক সাজানো হয় প্ল্যান-এ থেকে শুরু করে প্ল্যান-সি পর্যন্ত। এই তিনটি পরিকল্পনার ছক তারা এমনভাবে কষেছে যে, যদি প্রথম পরিকল্পনা তথা প্ল্যান-এ কার্যকর না হয়, তাহলে প্ল্যান-বি ধরে এগোবে। এভাবে তৃতীয় পরিকল্পনাও তারা সাজিয়ে রেখেছিল। উদ্দেশ্য সরকারকে মরণকামড় দেওয়া।

গোটা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পর্যবেক্ষক মহলের ভাষ্য হচ্ছে- এ হত্যাকান্ডকে কাজে লাগিয়ে দেশজুড়ে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাশাপাশি সুযোগ সন্ধানী মহলটি নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়ানো ও ধারাবাহিক উসকানিও দিচ্ছিল।

‘বাচাল’ নূরকে অ্যাসাইনমেন্ট
দেশের ভেতর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কূটকৌশল হিসেবে ‘বাচাল’ নূরকে ‘বক্তৃতাবাজি’ করতে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়। ‘নিধিরাম সর্দার’ নূরও বুঝে না বুঝেই গরম গরম কথা বলে নিজেকে হাসির খোরাকে পরিণত করেন।

এজন্যই তারা পরিকল্পিতভাবেই সেনা-পুলিশের ‘কল্পিত বিরোধ’ সামনে এনে নানামুখী গুজব ছড়িয়ে সরকারকে বিপাকে ফেলতেই আঁটঘাট বেঁধে মাঠে নেমে পড়ে।

গুজব ও মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে দেশের মতোন বিদেশেও সরকার বিরোধী বিদেশী মহলকে ক্ষেপিয়ে তোলতেও ‘ছক’ কষা হয়।

পর্যবেক্ষক মহলটি আরও বলছেন, দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা কখনও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী আবার কখনও সুইডেনে পলাতক ‘ফরমায়েশী রাইটার’ বা জার্নালিজমের অপচর্চা করা কুশীলবদেরও ব্যবহার করে প্রায়শই ‘খিস্তিখেউর’ করে বেড়াচ্ছে।

কিন্তু মতলববাজদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়ায় তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে দেশের সাধারণ মানুষ।

কেউ কেউ বলছেন, দেশে যখনই কোন ঘটনা ঘটে, তখন সেই ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করা হয় যেন তা সরকারের বিরুদ্ধে যায়, যেন তাঁতে সরকার চাপে পড়ে। হোক তা করোনা, হোক তা গণমাধ্যম কর্মী গ্রেফতারের ঘটনা কিংবা সিনহা’র মতো একটি হত্যাকান্ড।

সরকার পক্ষের কেউ কেউ বলছেন, শোকের মাস আগস্ট ঘিরে প্রতি বছরই নানা ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়। সরকার উৎখাতের চক্রান্তে তৎপর হয় অশুভ শক্তি। এ চক্রটি শোকের মাস আগস্টকে বার বার বেছে নিচ্ছে।

সূত্র মতে, একটি মহল সবসময় ওঁৎ পেতে থাকে যে, কখন একটি ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে, ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা যাবে। অতীতের মতোই এমন প্রবণতা সিনহা হত্যাকান্ডের বেলাতেও শুরু করেছিল চক্রটি।

স্পষ্ট লক্ষণীয়, একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ স্পৃহায় তাঁরা ফুঁসছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে স্বাধীনতা বিরোধীদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের নানামুখী প্রপাগান্ডা এসব অপতৎপরতারই বহি:প্রকাশ।

অপচেষ্টা সফল হতে দেননি সেনা ও পুলিশ প্রধান
একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক কালের আলোকে বলেন, স্বাধীনতা বিরোধী মহলটি দুই বাহিনীকে মুখোমুখি করতেই এক অকল্পনীয়ও দূর্ভাগ্যজনক ঘটনায় গুজব ছড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে সফল হতে পারেনি।

সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশ প্রধান ড.বেনজীর আহমেদ চক্রটির এই ‘খোয়াব’ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিয়েছেন।

সূত্র জানায়, সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যাকান্ডকে ঘিরে চিহ্নিত চক্রটি দুই বাহিনীর মধ্যকার আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্কে চিড় ধরাতেই নানা রকম ‘নাটক’ মঞ্চস্থ করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ইতোমধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ইতোমধ্যেই এ তদন্ত কার্যক্রমও পুরোদমে শুরু হয়েছে। পুরো তদন্ত প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে বুধবার (০৫ আগষ্ট) সেনাবাহিনী প্রধান ও পুলিশের আইজি সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

নিজ নিজ বাহিনীর স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি তারা প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাও প্রদান করেছেন।

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বৃহস্পতিবার (০৬ আগস্ট) জানিয়েছে, সেনাবাহিনী প্রধান ও পুলিশের আইজি উভয়ই এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দায়ভার বাহিনী নিবে না বলে উল্লেখ করেছেন।

এ ঘটনায় দুই বাহিনীর দীর্ঘদিনের পারস্পরিক সুসম্পর্কে চিড় ধরবেনা। সুষ্ঠু তদন্ত এবং সুবিচারের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে ও সুষ্ঠুতদন্ত কাজে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করা হবে না এবং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত পরিচালিত হবে।

সূত্র মতে, দুই বাহিনী প্রধানের কঠোর নির্দেশনা ও তদন্তে নিরপেক্ষতার প্রমাণও মিলতে শুরু করেছে।

ইতোমধ্যেই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা’র বোনের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর প্রধান আসামি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের আইসি মো. লিয়াকত, টেকনাফ থানার প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন।

আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ওসি প্রদীপসহ ৭ আসামির ৭ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

একই সূত্র জানায়, কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভসহ পুরো এলাকায় আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ টহল পরিচালনা শুরু হয়েছে। সেনা ও পুলিশ প্রধানের যৌথ নির্দেশনায় এ যৌথ টহল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দুই বাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান আস্থা আরও গভীর ও সুদৃঢ় করবে বলেই মত দিয়েছেন সেনা ও পুলিশ প্রধান।

আর সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র‌্যাব)।

কালের আলো/আরআই/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email