ছাত্রলীগে সোহাগ-জাকিরের বিদায় ঘন্টা!

প্রকাশিতঃ 12:30 am | January 06, 2018

বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো:
সাইফুর রহমান সোহাগ ও এস.এম.জাকির হোসাইনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি মেয়াদ পেরিয়েছে আরো ৫ মাস আগেই। তবুও নেতৃত্বে বহাল রয়েছেন তাঁরা। নতুন সম্মেলনের আওয়াজ উঠলেই তাঁরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দায় চাপান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর। কখনো আবার বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পরই সম্মেলন হবে!

কিন্তু যত কথাই তাঁরা বলুন না কেন, তাদের আর মানতে রাজি নন নিজ কমিটির বেশিরভাগ নেতাই। তাঁরা বর্তমান কমিটিকে অবৈধ ঘোষণা করে নতুন সম্মেলনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নিলেও হাইকমান্ডের নির্দেশে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। এখন তাদের অপেক্ষা আগামী সোমবারের আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাকে ঘিরে।

ওইদিন দলের সভাপতিমন্ডলীর একজন সদস্য বিষয়টি দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে আসতে চান। মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রলীগের এ কমিটিকে ঘিরে দলের ভেতরে ক্ষোভ-অসন্তোষ ও গৃহদাহের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারেন আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম।

জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৬ ও ২৭ জুলাই সাইফুর রহমান সোহাগকে সভাপতি ও এস এম জাকির হোসাইনকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বর্তমান কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। কিন্তু ছাত্রলীগের এ দু’শীর্ষ নেতার কারো মুখেই সম্মেলন নিয়ে কোন কথা নেই। দু’ নেতার ভাবখানা এমন, ক্ষমতার চেয়ারে বসে থাকতেই যেন স্বাচ্ছন্দ্য তাদের।
ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে রীতিমতো আ’লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম এ সংগঠনে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। আর এ অস্থিরতা ও কোন্দল প্রকাশ্যে আসে গত বছরের ১২ জুলাই। সংগঠনের ওই সাধারণ সভায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস.এম.জাকির হোসাইন নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়েন। সোহাগ ও জাকিরের বিলাসী জীবনই মূলত দলের সুবিধা বঞ্চিত, ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতা-কর্মীদের গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ওই সভায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েম খান সংগঠনের সভাপতি সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক জাকিরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনারা এত টাকা বাসা ভাড়া দেন সেই টাকা পান কোথায়? আপনাদের টাকার উৎস কি?

তিনি ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মানাধীন শেখ রাসেল টাওয়ার এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তমা কন্সট্রাকশন’র কাছ থেকে চাঁদা তোলার ও অভিযোগ তোলেন এবং তার কাছে এ সম্পর্কিত তথ্য প্রমাণ আছে বলে জানান।
সায়েম খানের এসব অভিযোগের জবাবে সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন বলেন, ছাত্রলীগের জন্য নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) আমাদের মাসে দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা দেন। তখন সায়েম খান বলেন, সেই টাকাতে তো আমার ও ভাগ আছে, আমার ভাগ কোথায়?’

সায়েমের এসব বক্তব্যকে ঘিরে ওই সময় সভায় বেশ হট্টগোলও হয়। গত কমিটি থেকেই এ ধারার প্রচলন ঘটেছে বলে জানা যায়। এছাড়া টেন্ডারে ভাগ না দেয়া, ফেসবুক কেন্দ্রিক রাজনীতিকে প্রাধান্য দেয়া এবং ক্ষোভ প্রশমনে উদ্যোগী না হওয়ায় শীর্ষ দুই নেতা বাকি নেতাদের সমালোচনার বাণের মুখে পড়েন।

এর আগে হেলিকপ্টারে করে ঈশ্বরদীতে এক সম্মেলনে যোগ দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। পরে এ সমালোচনার মুখে নিজে মিডিয়া কভারেজ পেতে বাসে চড়ে এক জেলা থেকে ঢাকায় ফিরেন জাকির হোসাইন। বাসে ঘুমিয়ে আসার সেই দৃশ্য আবার ফেসবুকেও ছাড়েন জাকির।

দলীয় নেতা-কর্মীরা জানান, নানান কারণে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ওপর বেশিরভাগ নেতা-কর্মী ক্ষুব্ধ। এর মধ্যে খোদ দলীয় গঠনতন্ত্র না মানার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, প্রতি দু’মাস পরপর নির্বাহী সংসদের সভা হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান কমিটি মাত্র একটি সাধারণ সভা করেছে।

এছাড়া কাউন্সিলর, কেন্দ্রীয় কমিটি, সম্পাদকমণ্ডলীর সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ ৩০১ সদস্য নিয়ে গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে এই সংখ্যা সাড়ে ৪’শ ছাড়িয়েছে। দলীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক শুধু নিজেদের এবং অনুগত অনুসারীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দলটির গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাই দলীয় রাজনীতিতে নিজেদের নিষ্ক্রিয় করে রেখেছেন। এর পেছনে রয়েছে তাদের অবমূল্যায়নের বিষয়টি।

সূত্র মতে, গত পহেলা বৈশাখে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের নেতাদের জন্য শুভেচ্ছা কার্ড পাঠালেও তা বিতরণ না করে মধুর ক্যান্টিনের রান্না ঘরে ফেলে রাখা হয়। ওই সময় মিডিয়ায় বিষয়টি প্রকাশিত হলে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে সংগঠনের ভেতরে-বাইরে বেশ সমালোচনায় পড়ে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক।

ছাত্রলীগের ৭০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতেও নতুন করে সম্মেলনের দাবি জোরালো হয়। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আগেই এ কমিটিকে মেয়াদোত্তীর্ণ ঘোষণা দিয়ে মাঠ গরম করেন কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েক নেতা। তাঁরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলনের দাবি জানিয়ে গত মঙ্গলবার সকালে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। কিন্তু সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) উপস্থিত হয়ে তাঁরা জানান, কর্মসূচিটি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। অবশ্য কারো চাপে তারা সম্মেলন স্থগিত করেননি বলেও দাবি করেন।

ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েম খান ওইদিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। তাই আমরা সংবাদ সম্মেলন করে কেন্দ্রীয় সম্মেলন দাবি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দলের (আওয়ামী লীগ) হাইকমান্ড থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাঁরা আমাদের দাবি শুনবেন এবং আমাদের কথা নেত্রীকে জানাবেন। আশা করছি, একটি ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।’

সূত্র মতে, আওযামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বেশ কয়েকবার দ্রুত সময়ের মধ্যে ছাত্রলীগের সম্মেলন হবে জানিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলোর মুখে দেখেনি দলের অন্যতম নীতি নির্ধারক এ নেতার বক্তব্য। তবে সোমবারের আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সভায় বিষয়টি উত্থাপিত হলে সম্মেলনের দাবির বিষয়ে মুখ খুলতে পারেন ওবায়দুল কাদের। এমন কথাই ভাসছে দলীয় পরিমন্ডলে।

সূত্র জানায়, সোহাগ ও জাকির মেয়াদোত্তীর্ণ এ কমিটিকে আরো প্রলম্বিত করতে চান। তাদের টার্গেট একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তারা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্তর্ভূক্ত অনেক ইউনিটে সম্মেলন বাকী রয়েছে। এসব কমিটি করে তবেই সম্মেলনের দিনক্ষণ নির্ধারিত হবে।

কিন্তু তাদের এ টার্গেটে রীতিমতো বাঁধ সেধেছে নিজ কমিটিরই অনেক নেতা। দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা না আসলে তারা আবারো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে নামতে পারেন। ছাত্রলীগের রাজনীতিকে আরো গতিশীল ও চাঙ্গা করতে মেয়াদোত্তীর্ণ এ কমিটির শীর্ষ দু’ নেতার হাত থেকে নতুন নেতৃত্বের হাতে ছাত্রলীগকে তুলে দিতে চান তাঁরা।

দলীয় পরিমন্ডলে শোনা যাচ্ছে, ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস.এম.জাকির হোসাইন তাদের ‘মেন্টর’ হিসেবে পরিচিত কয়েক নেতার সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করছেন। যে কোন মূল্যে আরো কিছু সময় চান তাঁরা। কথিত ‘মেন্টর’ এসব নেতারা যাতে করে বিষয়টি আ’লীগের শীর্ষ নেতাদের বুঝাতে পারেন এজন্যও শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি বড় অংশ  সম্মেলন দাবিতে নাছোড়বান্দা ভূমিকায় থাকায় এ নেতারা গভীর চিন্তায় পড়ে গেছেন।

সূত্র বলছে, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস.এম.জাকির হোসাইন বিদেশে অবস্থানরত এক নেতার হাত ধরেই ছাত্রলীগের মূল নেতৃত্বে আসেন। তিনি রাজধানীর পরিবাগের যে ফ্ল্যাটে থাকেন সেখানেই থাকতেন ওই নেতা। তাঁর কথায় মূলত উঠেন-বসেন জাকির, এমন কথাবার্তাও শোনা যায় নেতা-কর্মীদের মুখে।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সম্মেলনের বিষয়ে সংগঠনের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, আমরা ছাড়াও আরো অনেক কমিটি দুই বছরের বেশি সময় ছিল। তখন তো কেউ সেইসব কমিটিকে অবৈধ বলেনি। আমরা জেলা কমিটি গঠনের কাজ শেষ করেই সম্মেলন করবো।

একই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস.এম.জাকির হোসাইন বলেন, নেত্রীর নির্দেশনা পেলেই ছাত্রলীগের সম্মেলন হবে। তিনিই নির্ধারণ করবেন ছাত্রলীগের পরবর্তী সম্মেলন।