দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ

প্রকাশিতঃ 3:59 am | May 27, 2018

এম এইচ কবীর, কালের আলো:
পূর্ব আকাশের উদীয়মান সূর্য তার কোমল আলোয় উদ্ভাসিত করার পূর্বক্ষণে, মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠে ভেসে আসে প্রাণবন্ত আযানের ধ্বনি। বহুদূর থেকে আকাশ ছোঁয়া সবুজ গাছপালার মাথার উপর দিয়ে উঁকি দেয় আকাশের সাথে মিশে থাকা সুউচ্চ গম্বুজ । যা দৃষ্টিনন্দন, নয়নাভিরাম, আকর্ষণীয় স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে তা হলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ।

দূর থেকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে মনে হয় দেয়ালে খচিত আছে স্বর্ণালংকার, সোনালী রংয়ের প্রলেপে ঝিলিক ছড়াচ্ছে হরহামেশাই। মসজিদের নকশাটি ইসলামী ও আধুনিক স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। স্থপতি সংসদ লিমিটেড’র একটি বিখ্যাত স্থাপত্য প্রকৌশল ফার্ম পরামর্শদাতা হিসেবে সেবা রেন্ডার করেছে।

মসজিদটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যস্থিত মীর মশাররফ হোসেন একাডেমিক ভবন ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ভবনের মাঝখানে অবস্থিত। চার তলা বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদটি ২.২৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে এর অবস্থান। এটি সিরামিক ও কনক্রিট দিয়ে তৈরী, ছোট বড় মোট ১৪ টি গম্বুজ রয়েছে। মাঝখানে ছাদের উপরের গম্বুজ এর উচ্চতা ৩৬.৫০ মিটার। চার কোণায় চারটি ২০০ ফুট উঁচু মিনার সহ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি ফটক। মসজিদ ভিত্তিক ক্যাম্পাস গড়ার পরিকল্পনা হিসেবে বিভিন্ন অনুষদ ভবন থেকে রয়েছে ১৫ ফুট প্রস্থের করিডোর। চার তলা বিশিষ্ট মসজিদের নিচ তলার আয়তন ৪ হাজার ৭৭১ বর্গমিটার।

এখানে রয়েছে ইসলামী গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র, ইসলামী ব্যাংক, ক্যাফেটেরিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার মোট আয়তন ৭ হাজার ১০০ বর্গমিটার, দোতলায় ৩ হাজার ১০০ জন, তিন তলায় ৮০০ জন ও চার তলায় ২ হাজার ৩০০ জন মোট ৬ হাজার ২০০ জন মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারবেন। নামাজের স্থানের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিরামিক ও ইট দ্বারা কেন্দ্রীয় মসজিদের পূর্ব দিকে বিকাশ এবং উন্নত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই উন্নয়ন কাজে ১ লক্ষ ১ হাজার ১২৫ বর্গফুট জায়গা প্রসার হবে।

এখানে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঈদের নামাজের জন্যও রয়েছে সুব্যাবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক সর্ববৃহৎ ও দেশের তৃতীয় বৃহত্তম মসজিদ হলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ। এই মসজিদে ৬ হাজার ২০০ ও ঈদের নামাজ উপলক্ষে ১০ হাজার তথা মোট ১৬ হাজারেরও বেশী মুসল্লি এক সাথে নামাজ আদায় করতে পারবেন।

উপরোক্ত বর্ণনানুযায়ী মসজিদটির সম্পূর্ণ কাজ এখনো সমাপ্ত হয়নি। নির্মাণাধীন এই কেন্দ্রীয় মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৪ সালে। তৎকালীন সরকারী অর্থায়নে এই ভিত্তিপ্রস্থর কাজের উদ্বোধন করা হয়। মসজিদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা ভিন্ন খাতে ব্যবহৃত হওয়ায় মসজিদটির কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। সম্পূর্ণ মসজিদ ও ইসলামী লাইব্রেরি নির্মাণ বাবদ মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৬৮৯ (৩.৩৬১ মিলিয়ন ইউ এস ডলার ) লাখ টাকা। মোট ৪৮০ (০.৮৩ মিলিয়ন ইউ এস ডলার ) লাখ টাকা ব্যয়ে বর্তমানে কাজ হয়েছে ৩৬ শতাংশ। বাকী ৬৪ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজন ৪ হাজার ৫০৬ ( ৫.৬১৬ মিলিয়ন ইউ এস ডলার ) লাখ টাকা।

১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ১০ বছর পর ৩৬ শতাংশ কাজ শেষ হলে ২০০৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী জনাব মোশারেফ হোসেন শাহজাহান উদ্বোধনের মাধ্যমে মসজিদটি নামাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে মসজিদটির উন্নয়ন কাজ লক্ষ্য করা যাচ্ছিলনা। হারাতে বসেছিল নয়নাভিরাম হবে এমন এক কারুকার্য। দীর্ঘ ২৪ বছর পর বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে মসজিদটির নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর পরিপূর্ণ রূপ।

বর্তমান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ হারুন-উর-রশীদ আসকারী অবকাঠামোগত উন্নয়ন, গবেষণাধর্মী শিক্ষা কার্যক্রম, আবাসিক সুবিধা নিশ্চিতকরণ, সেশনজট হ্রাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধন ও বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তেমনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় পর্যটনের স্থান হিসেবে সুপরিচিত করার জন্য দৃষ্টিনন্দিত নকশার মসজিদ এর সম্প্রসারণ কাজের উদ্বোধন করেন।

২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর শুক্রবার জুম্মা নামাজের পর এ সম্প্রসারণ কাজের উদ্বোধন করা হয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন শীর্ষক দ্বিতীয় ফেজ এর আওতায় কেন্দ্রীয় মসজিদ সম্প্রসারণ কাজে মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। সম্প্রসারণ কাজের অধীন বড় একটি গম্বুজসহ মসজিদের সম্মুখভাগের মূল কাজ সম্পন্ন হবে। এছাড়া মসজিদের মাঝ বরাবর পূর্বদিকে বায়তুল মোকাররাম মসজিদের ন্যায় চওড়া সিঁড়িও তৈরী হবে। এ ৪ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকায় ১৫ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হবে। এই ১৫ শতাংশ কাজ শেষ হবে ২০১৯ সালের জুন মাস নাগাদ।

সব মিলিয়ে মসজিদের ৫০ শতাংশ কাজ হবে তারপরেও বাকী থাকবে অর্ধাংশ কাজ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি’ এর অর্থায়নে মসজিদের বাকী ৫০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করতে উদ্যোগ নিয়েছে। দৃষ্টিনন্দন মসজিদকে পূর্ণাঙ্গ রূপদিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি’ এর কাছে ৪০ কোটি টাকার আবেদন করেছে। ‘কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি’ (কেজেআরসি ) এর অর্থায়নে এ কাজ সমাপ্ত হবে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে ‘কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি’র ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদ মুহসিন আলম প্রাথমিকভাবে মসজিদ পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন শেষে সংস্থাটির কাছে মসজিদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। পরবর্তীতে সংস্থাটির পরিচালক পরিদর্শনের মাধ্যমে বাকী কাজ সমাপ্ত করতে সম্মতি দিবেন বলে জানা গেছে।

প্রধান প্রকৌশলী ( ভারপ্রাপ্ত ) ইঞ্জিনিয়ার মোঃ আলিমুজ্জামান বলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদটির মডেল পূর্ণাঙ্গ হলে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি মসজিদের মধ্যে একটিতে পরিণত হবে। দীর্ঘদিন যাবৎ মসজিদের কাজ বন্ধ ছিল। বর্তমান প্রশাসন ইতোমধ্যে প্রায় ৫ কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে কাজ শুরু করছেন। বাকী কাজের জন্য আমরা প্রায় ৪০ কোটি টাকা কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটির কাছে আবেদন করেছি,তাদের সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ চলছে। আশা করা যায় কমবেশী অনুদান সেখান থেকে আসবে, আগামী চার বছরের মধ্যে আমরা মসজিদটির মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখতে পাবো।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ হারুন-উর-রশীদ আসকারী বলেন, “ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদটি বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম সেরা মসজিদ স্থাপত্যকর্ম। মসজিদের মূল নকশার কাজ পরিপূর্ণভাবে হলে এটি বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম সেরা মসজিদে রূপান্তরিত হবে। আমরা সীমিত পর্যায়ে সম্প্রসারণের কাজ শুরু করছি। আরো ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের কাজের জন্য কুয়েত মিশনের কাছে আমরা আবেদন করেছি, সেটি এখন বিবেচনাধীন আছে।”

কালের আলো/ওএইচ

** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে কালের আলো’র ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: KalerAlo/Facebook

Print Friendly, PDF & Email