‘সাইলেন্ট কিলার’ মাহমুদউল্লাহর ছয়ে ফাইনালে বাংলাদেশ
প্রকাশিতঃ 11:56 pm | March 16, 2018
কালের আলো রিপোর্ট:
ছক্কা হাঁকিয়ে বাংলাদেশকে ত্রিদেশীয় টি-২০ সিরিজের ফাইনালে তুললেন সাইলেন্ট কিলার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। শ্রীলঙ্কার ছুঁড়ে দেওয়া ১৬০ রানের টার্গেট ১ বল ও ২ উইকেট হাতে রেখে উল্লাসে মাতে লাল-সবুজের জার্সিধারীরা।
শেষ ওভারে দরকার ১২ রান। আগের বলেই সিঙ্গেল নিতে গিয়ে রান আউট হয়ে গেছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তার চেয়েও বড় কথা স্ট্রাইক হারিয়ে ফেললেন মাহমুদউল্লাহ। ম্যাচটাও কি হারিয়ে ফেললেন?
এরপর যা হয়েছে, সেটা হয়ে যাবে অনেক দিন গল্প করার মতো একটা উপলক্ষ। প্রথম বলে কোনো রান হলো না, পরের বলে সিঙ্গেল নিতে গিয়ে আউট মুস্তাফিজ। মাহমুদউল্লাহ স্ট্রাইকে, ৪ বলে দরকার ১২ রান। এরপরেই মাঠে শুরু হলো নাটক। ওভারের প্রথম ওভারে দুই বাউন্সারের জন্য প্রতিবাদ জানাচ্ছিল বাংলাদেশ। সাকিব আল হাসান নিজেই উত্তেজিত, বাংলাদেশের দলের অন্যরাও। একটা সময় মনে হচ্ছিল, সাকিব বোধ হয় মাহমুদউল্লাহদের মাঠ থেকে উঠে আসতে বলবেন। শেষ পর্যন্ত খালেদ মাহমুদ সুজন বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিরস্ত করেন তাঁকে।
খেলা শুরু হলো আবার। উদানার পরের বলে দারুণ একটা চার মারলেন কাভারের ওপর দিয়ে। সমীকরণ তিন বলে ৮। পরের বলে দুই রান নিলেন মাহমুদউল্লাহ, হয়ে যেতে পারতেন আউট। দরকার ২ বলে ৬ রান। উদানার বলটা পড়ল প্যাডে, মাহমুদউল্লাহ ফ্লিক করে সেটা আছড়ে ফেলেই মেতে উঠলেন উল্লাসে। প্রেমাদাসায় তখন শ্মশানের নীরবতা। প্রেমাদাসাকে স্তব্ধ করে শ্রীলঙ্কাকে ২ উইকেটে হারিয়ে ফাইনালে উঠল বাংলাদেশ। রোব বার সেখানে প্রতিপক্ষ ভারত।
অথচ তার আগে শ্রীলঙ্কার মতো না হলেও বাংলাদেশের শুরুটা ভালো হয়নি একদমই। স্কোরবোর্ডে ১১ রান ওঠার পরেই আকিলা দনঞ্জয়ার অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বলটা তাড়া করতে গিয়ে মিড অফে ক্যাচ তুলে দিলেন লিটন দাস। সৌম্য নয়, তিনে এলেন সাব্বির রহমান। প্রথম দুই বলেই দুই চারে শুরুটাও হয়েছিল দারুণ। কিন্তু যা হয়, ভালো শুরুর পর সুযোগটা নষ্ট করে এলেন সাব্বির। ৮ বলে ১৩ রান করার পর দনঞ্জয়ার বলটা মারতে এলেন ডাউন দ্য উইকেটে। কীভাবে যেন তা জমে গেল কুশল পেরেরার গ্লাভসে, ৩৩ রানে বাংলাদেশ হারাল দ্বিতীয় উইকেট।
তবে পরের দুজন ম্যাচটা শেষ করে আসবেন বলেই মনে হচ্ছিল। মুশফিকুর রহিম যদি এই সিরিজে বাংলাদেশের অর্জুন হতো, কৃষ্ণ হয়ে তার রথের সারথী অবশ্যই তামিম ইকবাল। তবে আজ তামিমই নেমেছিলেন অর্জনের ভূমিকায়, ভাগ্যও ছিল তাঁর পক্ষে। নিশ্চিত রান আউট থেকে একবার একটুর জন্য বেঁচে গেছেন, একবার ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গেছেন। তবে এর মধ্যে মুশফিককে নিয়ে বাংলাদেশকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন লক্ষ্যের দিকে।
এর মধ্যেই মুশফিক পেয়ে গেছেন টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে হাজারতম রান। দুজনের জুটিতে যখন ৬৩ রান হয়ে গেছে, তখনই অঘটন। আমিলা আপোনসোর বলটা ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে খেলতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন কাভারে। আগের দুই ম্যাচেই ৭২ রান করার পর আজ ১৮ রান করেই আউট হয়ে গেছেন মুশফিক। তামিম ফিফটি পেলেন, কিন্তু ফিরে গেলেন এর পর পরেই। এবার অবশ্য ভাগ্য আর পক্ষে ছিল না তাঁর, ডাউন দ্য উইকেটে এসে গুনাতিলকার বলটা খেলতে গিয়ে হলো না ঠিকমতো। কীভাবে কীভাবে যেন তা ধরে ফেললেন পেরেরা। চার রান পর সৌম্যও ফিরে গেলেন, হুট করেই ১২ রানের মধ্যে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলল বাংলাদেশ।
তামিম-মুশফিক যে রানরেটকে বশে রেখেছিলেন, হঠাৎ করেই যেন তা হয়ে গেল কঠিন। শেষ ৫ ওভারে দরকার ৫০ রানের কাছাকাছি, ক্রিজে সাকিব-মাহমুদউল্লাহ। সাকিবের ম্যাচ ফিটনেসের অভাবটা বোঝাই যাচ্ছিল, দায়িত্ব তুলে নিতে হলো মাহমুদউল্লাহকে। কে জানত, ১৮ বলে ৪৩ রান করে এমন অবিশ্বাস্য এক জয় এনে দেবেন?
অবশ্য তার আগে ভাবা যায়নি, কে জানত, এমন শুরুর পর বোলিংয়ে বাংলাদেশের এমন শেষ হবে? ৪২ রানে ৫ উইকেট ফেলে দিয়ে শ্রীলঙ্কা যখন বাংলাদেশের হাবায় ক্ষৎবিক্ষত, কে জানত, তারা সেখান থেকে এভাবে ঘুরে দাঁড়াবে? শেষ পর্যন্ত রান হয়ে গেছে ১৫৯, তাতে বড় অবদান দুই পেরেরা-কুশল ও থিসারার।
অথচ বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিল স্বপ্নের মতো। সাকিব আল হাসান ফিরলেন, তাতেই যেন জাদুমন্ত্রের মতো বদলে গেল বাংলাদেশ। টসে জিতে শুরুর ভাগ্যটাও সুপ্রসন্ন হলো তাঁর, বোলিং পেল বাংলাদেশ।
প্রথমটা এনে দিয়েছিলেন নিজেই। নিজের প্রথম ওভারে দিয়েছিলেন ৩ রান, দ্বিতীয় ওভারে কুশল মেন্ডিস রুবেলের বলে পর পর দুই চারে আগের ম্যাচের মতো ঝড়ের আশা দেখাচ্ছিলেন শ্রীলঙ্কাকে। কিন্তু তৃতীয় ওভারেই সাকিবকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন দানুশকা গুনাতিলাকা। ঠাণ্ডা মাথায় ক্যাচ নিলেন সাব্বির, ১৫ রানে শ্রীলঙ্কা হারাল প্রথম উইকেট। গুনাতিলাকা করলেন ৪।
মুস্তাফিজুর রহমান আগের তিন ম্যাচেই স্বভাববিপরীতভাবে খরুচে ছিলেন। তবে নিজের সেরাটা যেন সেমিফাইনালের জন্য জমিয়ে রেখেছিলেন। নিজের প্রথম ওভারে প্রথম বলে লেগ বাই হলো, পরের চার বলে কোনো রান হলো না। হাঁসফাঁস করতে থাকা কুশল মেন্ডিস শেষ বলে ক্যাচ দিলেন শর্ট মিড উইকেটে। ২২ রানে শ্রীলঙ্কা হারাল দ্বিতীয় উইকেট।
মুস্তাফিজের পরের ওভারটা শ্রীলঙ্কার জন্য আরও বড় ধাক্কা হয়ে এলো। দ্বিতীয় বল সিঙ্গেল নিতে গিয়ে ভুল বোঝাবুঝি থারাঙ্গা-কুশল পেরেরার, মিরাজার থ্রো ধরে মুস্তাফিজ স্টাম্প ভেঙে দিলেন। ৫ রানে ফিরলেন থারাঙ্গা। এক বল পরেই মুস্তাফিজের ট্রেড মার্কার অফ কাটার, উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে কোনো রান না করেই ফিরলেন দাসুন শানাকা। ৩২ রানে ৪ উইকেট হারাল শ্রীলঙ্কা, পাওয়ারপ্লেতে এলো ৩৫ রান। ৪১ রাএর মাথায় মিরাজকে সুইপ করতে গিয়ে শর্ট ফাইন লেগে মুস্তাফিজকে ক্যাচ দিলেন জীবন মেন্ডিস।
সেখান থেকেই শুরু শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়ানোর। থিসারা পেরেরা ও কুশল পেরেরা যে ঝড় তুলিবেন, সেই আভাস মিলেছিল ১১তম ওভারে গিয়ে। রুবেল হোসেনের ওই ওভারে পর পর দুই চার মারলেন পেরেরা। তবে ঝড়টা আসল ১৩তম ওভার থেকে। প্রথম দুই ওভারে ৪ রান দেওয়ার পর মুস্তাফিজ সেই ওভারে দিলেন ১৭ রান, কুশল পেরেরা মারলেন ছয়-চার। এর মধ্যে সাকিব মাহমুদউল্লাহ-সৌম্যদের নিয়ে বল করিয়ে গেছেন, অপু বা নিজেকে আনেননি বোলিংয়ে।
সুবিধাটা দুই পেরেরা নিয়েছেন ভালোমতোই। মুস্তাফিজের ওপরেই বেশী গেছে তোপ, তাঁর এক ওভারেই পর পর দুই ছয় মেরেছেন থিসারা। ৩২ বলে ফিফটির পর কুশলও মারছিলেন, শেষ পর্যন্ত ৪০ বলে ৬১ রান করে সৌম্যের বলে আউট হয়েছেন। কিন্তু অধিনায়ক থিসারা শেষ ওভারে আউট হওয়ার আগে করেছেন ৩৭ বলে ৫৮ রান। শেষ পর্যন্ত তা আর যথেষ্ট হলো না, এক মাহমুদউল্লাহর জন্য।
কালের আলো/এসএ/এমএ