সুবীর ভৌমিক এবং ঘাসকাটার সাংবাদিকতা
প্রকাশিতঃ 11:10 pm | October 07, 2017
গল্পটা ছিল এ রকম। ‘ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে যেমন তার দুই নিরাপত্তা রক্ষী গুলি করে হত্যা করেছে, ঠিক তেমনি একটা ষড়যন্ত্র হয়েছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে। দিন-তারিখও ঠিক হয়ে গিয়েছিল, ২৪ আগস্ট ২০১৭। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স বা এসএসএফের ছয় থেকে সাতজন সদস্য সিদ্ধান্ত নিলো- তারা সেদিন অ্যাকশনে নামবে। ষড়যন্ত্র অগ্রসর হচ্ছিলো তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ীই, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটা ভ-ুল করে দিল শেখ হাসিনার একান্ত বিশ্বস্ত কিছু কর্মকর্তা এবং কাউন্টার টেরোরিজমের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি। পুরো ষড়যন্ত্রটিই প্রথমে ধরা পড়ে ভারতীয় ও বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের যৌথ টিমের কাছে। তারা ওই বিপথগামী এসএসএফ সদস্যদের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী জেএমবির মধ্যেকার যোগাযোগটা ধরে ফেলে। সেখান থেকে তারা জানতে পারে তাদের ভয়ানক পরিকল্পনাটা। সঙ্গে সঙ্গে তারা ব্যবস্থা নেয়। প্রধানমন্ত্রীকে সেদিন বিকালে তারা আর বের হতে দেয়নি, ষড়যন্ত্রকারীদের পাকড়াও করে ফেলে এবং তাদেরকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’
গল্পের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। সে সব প্রসঙ্গে যাবো ক্রমশ। তার আগে বরং গল্পকার সম্পর্কে একটু বলে নিই। ওনার নাম সুবীর ভৌমিক। ভারতীয় নাগরিক। থাকেনও সেখানেই। এই দেশে তার অনেক নামডাক। আমাদের অনেক বড় বড় সাংবাদিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সখ্য। এখানকার নামিদামি কিছু পত্রিকা ও মিডিয়া তার লেখা প্রকাশ করে। তার বায়োডাটার দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে লেখা রয়েছে, ইনি একদা বিবিসির পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের ব্যুরো প্রধান ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশের বিডিনিউজ২৪ ডট কমের একজন সিনিয়র এডিটর এবং মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম মিজ্জিমা গ্রুপের একজন কনসাল্টিং এডিটর! বিডিনিউজের ওয়েব পেজে গিয়ে দেখি তারা এখন আর তাকে ‘সিনিয়র এডিটর’ হিসাবে স্বীকার করছে না, বরং তার দাবিকৃত পদের পূর্বে একটা ‘সাবেক’ শব্দ জুড়ে দিয়েছে। মিজ্জিমা অবশ্য এখনো তাকে তাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবেই স্বীকার করে।
তার পরিচিতির এতটুকু পড়ে তাকে মোটেই ‘গল্পকার’ নয়, বরং একজন সাংবাদিকই মনে হয়। বিবিসিতে যখন ছিলেন, হয়তো সাংবাদিকই ছিলেন। আবার সাংবাদিক হলেই যে গল্প লেখা যাবে না, তেমনও কোনো প্রতিজ্ঞা নেই। আমাদের দেশেও অনেক সাংবাদিক আছেন যারা নিয়মিত গল্প লিখেন। তবে তারা তাদের গল্পকে গল্প হিসাবেই প্রচার করেন, রিপোর্ট হিসাবে নয়। সুবীর ভৌমিক সেই সততাটুকু দেখাতে পারেননি। উনি তার গালগল্পকে সাংবাদিকতা হিসাবে চালান করে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তার ‘সাংবাদিকতা’ থেকেই কিছু নমুনা দিচ্ছি।
বিবিসিকে অনেকেই বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন। আমাদেরও অনেক বন্ধু-বান্ধব, সাবেক সহকর্মী কাজ করে থাকেন আন্তর্জাতিক এই সংবাদমাধ্যমে। যতদূর জানি, কোনো তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে ওদের একটা প্রাথমিক নীতিমালা রয়েছে। সেটা হচ্ছেÑ প্রাপ্ত যেকোনো তথ্য কমপক্ষে দুই বা ততোধিক সোর্সের কাছ থেকে কনফার্ম করে নেয়া। সুবীর ভৌমিকও সে কাজটি করেছেন বলে অন্তত পাঠককে বোঝাতে চেয়েছেন। যেমন, উনি ওনার নিবন্ধে একাধিক সোর্সের কথা জানিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই একাধিক সোর্সের সবই শতভাগ বায়বীয়। কোনো নাম নেই, কোনো সুনির্দিষ্ট পরিচয় পর্যন্ত নেই। ওনার চারটি গুরুত্বপূর্ণ সোর্সের দুটি নাকি বাংলাদেশের এবং দুটি নাকি ভারতীয়। ভারতের দুটি হচ্ছে এক্সটার্নাল ইন্টেলিজেন্স বিভাগের!
গল্পের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ঢাকার একজন ‘টপ অফিসিয়াল’ নাকি তাকে জানিয়েছে যে, ধৃত ওই ছয়-সাতজন এসএসএফ সদস্যকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কে এই শীর্ষ কর্মকর্তা? তার কোনোই ব্যাখ্যা নেই। আবার এক জায়গায় লিখেছেন এসএসএফের দুজন মেজর জেনারেল র্যাংকের কর্মকর্তাকে নাকি গোয়েন্দা সংস্থা সতর্ক নজরদারিতে রেখেছেন! এর অর্থ কি? তাহলে এত শীর্ষ পর্যায়ের লোকও এমন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত? সুবীর বাবু আসলে কি বলতে চান? উনি কোথায় ঝামেলা পাকাতে চান? কাদের স্বার্থে চান?
এখানে আর একটা কথা বলা জরুরি। এটা অবশ্য আমাদের সাংবাদিকতার জন্য কিছুটা আত্মসমালোচনার মতো। সুবীর ভৌমিকের লেখাটি প্রথমে, গত ২২ সেপ্টেম্বর, প্রকাশিত হয়েছে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম মিজ্জিমাতে। এর দুদিন পর, ২৪ সেপ্টেম্বর সেটি প্রকাশিত হয়েছে ভারতের ‘নিউজ ১৮’ নামের সংবাদমাধ্যমে। মিজ্জিমাতে আর্টিকেলটির লেখক সুবীর ভৌমিক, আর নিউজ ১৮তে লেখক হিসাবে সুবীর ভৌমিকের সঙ্গে মনোজ গুপ্ত নামে আরও একজনের নাম ছাপা হয়েছে। দুটি আর্টিকেলের বিষয়বস্তু এক এবং অভিন্ন। ওই শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ২৪ আগস্ট হামলার দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছিল; এর পিছনে জেএমবি, এসএসএফের কয়েকজন, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি গোষ্ঠী কাজ করছে, এইসব।
গল্পটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য ইংল্যান্ড সফররত বিরোধীদলীয় নেত্রীকেও টেনে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, তার সঙ্গে লন্ডনে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের এক কর্মকর্তা দেখা করার পরেই নাকি এসব ঘটেছে। ভারতের মূলধারার কোনো সংবাদমাধ্যম ভৌমিক বাবুর এই দুর্দান্ত তথ্যপ্রকাশকে গুরুত্ব না দিলেও আমাদের অনেকে কিন্তু দিয়েছে। ভারতের ওই গুরুত্বহীন মিডিয়ার বরাতে আমাদের অনেক টিভি এবং অনলাইন পোর্টালে এই ‘খবর’ দ্রুত প্রচার হয়েছে। তবে সরকারের ভূমিকাও ছিল ভালো, দ্রুতই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছেÑ এই ‘খবর’টি সম্পূর্ণই ভিত্তিহীন। সেদিনই একাধিক মন্ত্রীর সমন্বয়ে গঠিত আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কমিটিও ওই খবরটিকে ভুয়া হিসাবে অভিহিত করেছে।
এই যে একটা ভুয়া খবর, চলে এলো অনলাইনে, দেখলো দেশ-বিদেশের সবাই, এর দায়িত্ব তাহলে কার ওপর বর্তাবে? আমাদের দেশে এ সংক্রান্ত আইন আছে, এমন নিউজ আমাদের এখানে করে কেউ পার পাবে বলে তো মনে হয় না। এমনিতে এখানে নানা ছোটখাটো ছুতানাতাতেও অনেক সংবাদকর্মীকে হয়রানি করা হয়। আর এরকম মারাত্মক এবং ক্ষতিকর রকম ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচার করা হলে কি ব্যবস্থা নেয়া হতো, সেটা ভাবাই যায় না। এ প্রসঙ্গে ভিত্তিহীন এই নিউজটির একটি উপকারী দিকের কথা বলা যায়। এটি অনেকেই পড়েছে এবং বিশ্বাস না করে উপেক্ষা করেছে। এই নিউজটির কারণে দেশ ও জাতির বিশাল কোনো ক্ষতি কি হয়ে গেছে? না, হয়নি। দেশ ও জাতি ঠিক থাকলে এসব গালগল্প কোনোই প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তাই মানুষের মতপ্রকাশের স্বার্থে ওই ৫৭ ধারা টারার তেমন কোনো দরকার নেই। মতপ্রকাশের নামে কেউ কোনো মিথ্যা বা ধান্দার কথা প্রচার করতে গেলে, কাজের কাজ তো কিছু হবেই না বরং সে নিজেই অবিশ্বস্ত হিসাবে প্রমাণিত হবে। যেমনটি এখানে হয়েছেন সুবীর ভৌমিক।
সুবীর বাবুর ধান্দাটি কিন্তু খুব একটা অস্পষ্ট নয়। টাইম লাইনটার দিকে একবার তাকানো যাক। প্রথমে ২২ সেপ্টেম্বর ওনার লেখাটি প্রকাশিত হলো মিয়ানমারের মিজ্জিমাতে। সেটা নিয়ে তেমন একটা আলোচনা না হওয়াতে ২৪ সেপ্টেম্বর একটু যোগ-বিয়োগ করে প্রচারিত হলো নিউজ১৮ তে। লেখাটিতে বলা হলো ২৪ আগস্টের কথা, সেদিনই নাকি হামলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এর ঠিক পরদিন, অর্থাৎ ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সরকার তাদের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা শুরু করে। এর মাঝে আবার তিনি সুকৌশলে আইএসআইর কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার আশফাক এবং আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মিলেটারি শাখার প্রধান হাফিজ তোহারের টেলিফোন সংলাপের বিষয়টিও ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এভাবে তিনি যেন আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের একটা যৌক্তিকতাও প্রচ্ছন্নভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। কনসাল্টিং এডিটর হিসাবে তিনি তার লেখায় মিজ্জিমা তথা সেই মাধ্যমে মিয়ানমারের স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা যদি করে থাকেন, তাতে খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। তবুও বিবিসিতে একদা কাজ করার কারণে তার কাছে কিছুটা হলেও পেশাদারিত্ব কিন্তু আমরা আশা করতে পারি। তিনি আমাদেরকে হতাশ করেছেন।