জেনারেল ওয়াকারের বার্তা পরিস্কার

প্রকাশিতঃ 11:41 pm | May 22, 2025

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর; কালের আলো:

চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ মে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর দু’টি বক্তব্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ঠাঁই করে নিয়েছে। রাওয়ার প্রথম বক্তব্যটিতে তিনি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাইকে সতর্ক করেছিলেন। একইভাবে বুধবার (২১ মে) ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর অফিসার্স অ্যাড্রেস অনুষ্ঠানে সমসাময়িক নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে সোজা সাপ্টা কথা বলেছেন তিনি। দু’টি বক্তব্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বা মাজেজা অভিন্ন হলেও দেশের চলমান অরাজকতা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সময়টিতে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তাঁর বক্তব্যে কী বার্তা দিলেন, এ নিয়ে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। কম কথার মানুষ হিসেবে পরিচিত সেনাপ্রধান দেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ দূরে সরিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পুনরায় খোলাসা করেছেন।

দ্রুত নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁর এই ভাষা প্রয়োগ অত্যন্ত শক্ত এবং কঠোর। চলমান সংস্কার, মিয়ানমারে মানবিক করিডর, চট্টগ্রাম বন্দর, মব সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি যে সন্তুষ্ট নন বরং বিরক্ত সেটি তাঁর অভিব্যক্তিতেই সহজেই অনুমান করা যায়। বলতে দ্বিধা করেননি তিনি নয় মাস ধরে অভিভাবকহীন হয়ে রয়েছেন। বলেছেন, ‘এক চাতক পাখির মতো একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। একটি নির্বাচিত সরকার সেনাবাহিনীর জন্য অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে এবং যার ফলে সার্বিকভাবে দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে।’

আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যেই মানবিক করিডরের নামে প্রক্সি ওয়ারের শঙ্কা ও বিদেশিদের কাছে চট্টগ্রাম বন্দর ইজারার পায়তাঁরার ঘটনায় এমনিতেই উত্তপ্ত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ হচ্ছে একদিন-প্রতিদিন। সময়, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও ঘটনা প্রবাহ বিবেচনায় সেনাপ্রধানের সময়োচিত কথাবার্তা রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে চায়ের কাপেও ঝড় তুলেছে। সচেতন মহল তাঁর এই বক্তব্যকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবেই দেখছেন। বিশেষ করে সেনাপ্রধান যখন উচ্চারণ করেছেন- ‘প্রথম দিন থেকেই প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে তিনি বারবার সরকারকে অনুরোধ করেছেন। তবে সরকার অনুরূপ সংস্কারের বিষয়ে সত্যিকার অর্থে সিরিয়াস নয়।’ সংস্কারসহ বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকার কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বা কীভাবে নিচ্ছে সে বিষয়ে দেশবাসীর পাশাপাশি তিনি এবং সেনাবাহিনী অবগত নন বলে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এ থেকেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় অন্তর্বর্তী সরকার এসব ক্ষেত্রে গণঅভ্যুত্থান সফলের অব্যর্থ হাতিয়ার সশস্ত্র বাহিনীকে এক প্রকার অন্ধকারে রেখেছে। কোন রকম মতামত গ্রহণেরও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন সম্পর্কে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, ‘জাতিসংঘ কর্তৃক জুলাই-আগস্ট বিষয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে তাতে সেনাবাহিনীর কোনো বক্তব্য নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানতে পারেন, জাতিসংঘ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেও বর্তমান সরকার জাতিসংঘকে সে সুযোগ দেয়নি।’ এমন পরিস্কার বক্তব্যের পর আকার-ইঙ্গিতের আর কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তাঁর প্রতিটি শব্দ, বাক্য ও অভিব্যক্তি লক্ষ্য করলে খোলাসা হয় তিনি এসব ঘটনায় আশাহত হয়েছেন। তাঁর এই স্পষ্ট বার্তাটি আর ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই। যে যার মতো বুঝে-শুনে মিলিয়ে নিতে পারেন।

সেনাপ্রধান অফিসার্স অ্যাড্রেস অনুষ্ঠানে বক্তব্যের এক জায়গায় সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘দেয়ার উইল বি নো করিডর’। তিনি বলেছেন, ‘মানবিক করিডরের মতো স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার বর্তমান সরকারের নেই। শুধু একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারই যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক এরূপ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’ চারতারকা জেনারেল আরও বলেছেন, ‘করিডর বিষয়ে সরকার কী ভাবছে অথবা জাতিকে একটি প্রক্সি ওয়ারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কি না, এ বিষয়ে সরকার স্পষ্টভাবে কিছুই জানাচ্ছে না।’ একইভাবে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়া নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনা ও বিতর্কের বিষয়েও তিনি মুখ খুলেছেন। এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার এই সরকারের নেই। এখানে স্থানীয় মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের মতামত প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’ বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশ ও জনগণের কোনোরকম ক্ষতি হোক এমন কোনো কাজ সেনাবাহিনী করবে না, কাউকে করতে দেবে না বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তিনি।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির নিজেদের মধ্যে বিরোধ-বিভক্তি চরমে ওঠে। পরমতসহিষ্ণুতা তথা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাই যে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে এক বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে। প্রতিশোধপরায়ণতা ভীষণরকম বেড়েছে। বিগত বছরগুলোয় যারা রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিকভাবে নির্যাতিত ও বঞ্চিত হয়েছেন, তারা এখন প্রতিশোধ নিচ্ছেন। অতীতে একটি পক্ষ যেমন প্রতিপক্ষকে চিরতরে নির্মূল করতে চেয়েছে, ৫ আগস্টের রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের পরে সেই শক্তিকেই নির্মূলের চেষ্টা চলছে। অর্থাৎ ক্ষমতায় গেলে সবাই যে তার প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে এককভাবে টিকে থাকতে চায়, এই প্রবণতাটি বেড়েছে-যা দেশকে স্থিতিশীল করার বিপরীতে আরও বেশি সংঘাতপূর্ণ করে তুলছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, ‘আন্দোলনের নাম করে দেশে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে। কোনভাবেই কোন পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বেড়েই চলেছে অপরাধ প্রবণতা। বাড়বাড়ন্ত হয়ে ওঠেছে মব সন্ত্রাস। আইনবহির্ভূতভাবে মব সৃষ্টিকারীদের থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। ন্যূনতম আইনি প্রক্রিয়াও অনুসরণ করা হচ্ছে না। হত্যা মামলার নামে তামাশা চলছে। একের পর এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র চলছে। সামগ্রিক এসব পরিস্থিতিতে মোটেও সন্তুষ্ট নন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

আবার, শুধু ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির বিষোদগার নয়, বরং সেনাবাহিনীকে নিয়েও অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মে ইচ্ছেমতো বিষোদগার করছেন-যা স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন। সেনাপ্রধান এই বিষয়টিও উত্থাপন করেছেন অফিসার্স অ্যাড্রেস অনুষ্ঠানে। তিনি অভিযোগের সুরেই বলেছেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে সেনাবাহিনীর অক্লান্ত ও নিঃস্বার্থ ভূমিকা সত্ত্বেও বিভিন্ন মহল থেকে সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানকে টার্গেট করা হচ্ছে, যা হতাশাজনক। দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহল পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে যাচ্ছে যাতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে পারে।’ তিনি দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ও সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘সার্বিকভাবে দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসনসহ সব সংস্থা ভেঙে পড়েছে এবং পুনর্গঠিত হতে পারছে না। শুধু সশস্ত্র বাহিনী এখন পর্যন্ত টিকে আছে এবং দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।’

একটি আধুনিক রাষ্ট্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা এবং ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়। তাই নতুন-আধুনিক ও স্বপ্নময় দিগন্তকে টেকসই করতে অপিরহার্য একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপক্ষে জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, এটি এখন বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মনে করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও। তিনি জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তার অবস্থান আগের মতোই। দেশের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণের অধিকার একটি নির্বাচিত সরকারেরই রয়েছে। সেনাপ্রধান স্পষ্টভাবে বলেন, ‘যথাশীঘ্র সম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’ আসন্ন নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে সততার সঙ্গে নিরপেক্ষ থেকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করবার জন্যও তিনি নির্দেশনা প্রদান করেন।

দীর্ঘ সময় সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্টের বাইরে থাকায় দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেছেন, ‘এত দীর্ঘ সময় ধরে সেনাসদস্যরা শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় মোতায়েন রয়েছেন; যা সার্বিকভাবে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই তিনি একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর যথাশীঘ্র সম্ভব সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেবেন বলে উল্লেখ করেন। এটা না করতে পারলে বিদ্যমান বিশ্ব পরিস্থিতি ও প্রতিবেশী অঞ্চলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।’ তিনি সবাইকে অর্পিত দায়িত্ব সর্বোচ্চ কর্তব্যপরায়ণতা ও আনুগত্যের সঙ্গে পালন এবং মজলুমদের অশ্রুজল যাতে না ঝরে এবং তাদের অধিকার রক্ষায় সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করার জন্য বাহিনীটির সর্বস্তরের সদস্যদের নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ এবং অর্পিত দায়িত্ব ও দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ থাকার নির্দেশনা প্রদান করেন। নিজ অবস্থান ও আদর্শে অবিচল থাকলে কোনো মহলই সেনাবাহিনী ও দেশের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

সেনাপ্রধানের এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা একটা বড় কারণ বলে মনে করছেন অনেকেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত বছরের ৩ আগস্ট সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে অফিসার্স অ্যাড্রেস অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেছিলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনী ছাত্র-জনতার বুকে গুলি চালাবে না।’ তাঁর এমন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তেই নির্ধারিত হয়েছিল পতিত সরকারের ভাগ্য। ফলে এবারের অফিসার্স অ্যাড্রেস অনুষ্ঠানটিও স্বভাবতই বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের গত ৯ মাসের কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। প্রকট হয়ে ওঠেছে আস্থার অভাব। রাজনৈতিক দলগুলোও মনে করছে, সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। এর প্রভাব পড়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে শুরু করে সামগ্রিক অর্থনীতিতেও। রাজপথে নানান দাবিদাওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন, অন্যদিকে বিভিন্ন পেশাজীবীর অবস্থান, অবরোধের কারণে রাজধানী এখন অচল। জনদুর্ভোগ-ভোগান্তি নিত্যদিন। কোথাও সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। সন্ত্রাস ও সহিংসতাও থামানো যাচ্ছে না। পরিকল্পিত তাণ্ডবে ‘বরবাদ’ হচ্ছে দেশ। এমন প্রেক্ষাপটে একটি গ্রহণযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানই এখন সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সেনাপ্রধান তাঁর বক্তব্যে এসব বিষয়ই বুঝাতে চেয়েছেন। এখন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের টনক থাকলে নড়া উচিত।’

সেনাপ্রধানের সময়োপযোগী এসব বার্তার একদিনের মাথায় বৃহস্পতিবার (২২ মে) রাতে ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে প্রাণরক্ষায় রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ মোট ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া ও আশ্রয় দেওয়া মানুষদের মধ্যে ৫৭৮ জনের নাম প্রকাশ করেছে সেনা সদর দপ্তর। এদিন রাতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এই তালিকা প্রকাশের পাশাপাশি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ‘জুলাই আগস্টের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে বিগত সরকারের পতনের পর কতিপয় কুচক্রী মহলের তৎপরতায় সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। ফলশ্রুতিতে, সরকারি দপ্তর, থানাসমূহে হামলা, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর আক্রমণ ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, মব জাস্টিস, চুরি, ডাকাতিসহ বিবিধ বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। এ ধরনের সংবেদনশীল ও নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে দেশের নাগরিকদের মনে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম নেয়। এ অবস্থায়, ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব সেনানিবাসে প্রাণ রক্ষার্থে কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নাগরিকগণ আশ্রয় প্রার্থনা করেন। উদ্ভূত আকস্মিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সেনানিবাসে আশ্রয়প্রার্থীদের পরিচয় যাচাই বাছাই করার চাইতে তাদের জীবন রক্ষা করা প্রাধান্য পেয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে, ২৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ৫ জন বিচারক, ১৯ জন অসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা, ৫১৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ বিবিধ ১২ জন ও ৫১ জন পরিবার পরিজন (স্ত্রী ও শিশু) সহ সর্বমোট ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় প্রদান করা হয়েছিল। সেসময়ে শুধু মানবিক দায়বদ্ধতার কারণে আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে আশ্রয় প্রার্থীদের জীবন রক্ষা করাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। পরিস্থিতি উন্নয়ন সাপেক্ষে, আশ্রয় গ্রহণকারীদের বেশিরভাগই ১/২ দিনের মধ্যেই সেনানিবাস ত্যাগ করেন এবং এর মধ্যে ৫ জনকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ/মামলার ভিত্তিতে, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট হস্তান্তর করা হয়।’ বিশ্লেষকরা মনে করেন, ‘বিভিন্ন সময়ে অনেকেই এই তালিকা প্রকাশের বিষয়ে নানা কথা বলছিলেন। সঠিক সময়েই এই তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে সেনা সদর দপ্তর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি নিজেদের দায়িত্বশীলতারও স্বাক্ষর রেখেছে।

কালের আলো/এমএএএমকে