ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ: অর্থনীতি ও পরিবেশে প্রভাব

প্রকাশিতঃ 4:48 pm | May 22, 2025

ড.মো.মিজানুর রহমান, পিএইচডি:

ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশের (বিএটিবি) যাত্রা শুরু করে ১৯১০ সালে ‘ইংলিশ টোবাকো কোম্পানি’ হিসেবে। ১৯৯৮ সালে নাম পরিবর্তন করে ‘বিএটিবি’ রাখা হয়। (BATB, 2023; RJSC, বাংলাদেশ)। বর্তমান বিএটিবি এর প্রধান কার্যালয় ও কারিগরি স্থাপনা ঢাকা মহানগরীর মহাখালী ডিওএইচএস এলাকার সন্নিকটে অবস্থিত। এছাড়া চট্টগ্রামে পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন কেন্দ্র; সাভার ও ময়মনসিংহে কাঁচা তামাক সংগ্রহ কেন্দ্র ও গবেষণা কার্যক্রম এবং কুষ্টিয়া ও দিনাজপুরে চাষি কার্যক্রম এবং তামাক শুকানো কেন্দ্র রয়েছে। তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে বিএটিবি দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একটি। বহু দশক ধরে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও সাম্প্রতিককালে এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান, প্রভাব, মুনাফা, এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব নতুন করে প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানীর অভিজাত আবাসিক এলাকা মহাখালী ডিওএইচএসে তাদের হেড অফিস ও গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা দেশের আইন, পরিবেশ, ও নাগরিক অধিকারকে ঘিরে গভীর বিতর্ক তৈরি করেছে। কোম্পানির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্যের বাজারে আধিপত্য বজায় রেখে প্রচুর পরিমাণে লভ্যাংশ বিদেশে স্থানান্তর করা।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিএটিবি-এর অবদান

বিএটিবি বর্তমানে দেশীয় অর্থনীতিতে রাজস্ব, কর্মসংস্থান, কৃষি, এবং শিল্পায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে এর সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর হিসাব অনুযায়ী, বিএটিবি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ২৯,০০০ কোটি টাকা কর প্রদান করেছে, যা একই বছরে মোট সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট এবং ইনকাম ট্যাক্স সহ সমন্বিত রাজস্বের ১০ শতাংশের বেশি। কোম্পানিটি প্রতি বছর গড়ে ২৫,০০০ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব জমা দিয়ে থাকে, যা এনবিআর এর শীর্ষ ৫ করদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। বিএটিবি-এর তথ্য মতে, ২০২৩ সালে কর পরিশোধের হার ছিল তার মোট বিক্রয়ের ৭২ শতাংশের বেশি। (NBR, 2022–23।

বিএটিবি-এর সরাসরি কর্মরত সংখ্যা প্রায় এক হাজার ৫০০ জন হলেও পরোক্ষভাবে তারা প্রায় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি কৃষক ও চুক্তিভিত্তিক কর্মীকে নিয়োজিত রেখেছে। বিএটিবি তার প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলো বিশেষভাবে ঢাকার মহাখালী এবং কুষ্টিয়া জেলায় স্থাপন করেছে। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিএটিবি প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ পুনঃবিনিয়োগ করেছে নতুন প্রযুক্তি, উৎপাদন লাইন এবং পরিবেশ বান্ধব প্রকল্পে। (BATB, 2022; BIDA, 2023)। বিএটিবি ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে তারা সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। (BATB, 2023)। বিএটিবি নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করেছে ৮০০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করে এবং ১ কোটির বেশি বৃক্ষরোপণ করেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। তবে সমালোচকরা বলেন, CSR প্রকল্পগুলো মূলত তাদের ইমেজ ব্যবস্থাপনা কৌশল। (BATB CSR Report 2023।

বাংলাদেশের বিএটিবি-এর ক্ষতিকর প্রভাব

যদিও বিএটিবি অর্থনীতিতে রাজস্ব, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও রপ্তানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তবে এর পণ্যসামগ্রী জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাকজনিত রোগে প্রায় ১ লাখ মানুষ মারা যায় (WHO Bangladesh, 2022)। স্বাস্থ্যখাতে তামাকজনিত ব্যয় প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা বিএটিবি-এর রাজস্ব অবদানের চেয়েও বেশি।

প্রতিবছর সিগারেটের উপর সরকার উচ্চ ট্যাক্স আরোপ করে। ২০২৩ সালে, সিগারেট বিক্রির উপর গড় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ, কিন্তু তারপরও বিএটিবি এর নিট মুনাফা ছিল প্রায় ১,৫৬০ কোটি টাকা। এই বিপুল মুনাফার একটি বড় অংশ বিদেশে ব্রিটিশ মূল কোম্পানিতে মুনাফা হস্তান্তরের মাধ্যমে চলে যায়, যা বাংলাদেশে অর্থনৈতিক চক্রে ফিরে আসে না। এই টাকা দিয়ে দেশের অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা মানব উন্নয়নে কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা হয় না।

গবেষণা বলছে, তামাক চাষে নিযুক্ত কৃষকদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি মারাত্মক। নিকোটিন বিষক্রিয়া, কেমিক্যাল ইনহেলেশন, ও দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। ফ্যাক্টরি কর্মীদের মধ্যেও একই প্রবণতা দেখা গেছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা সুবিধা, স্বাস্থ্য বীমা বা পুনর্বাসন কার্যক্রম দুর্বল। একটি ২০২১ সালের রিপোর্টে দেখা যায়, বিএটিবি-এর নিজস্ব কর্মচারীদের ৪৫ শতাংশ ধূমপানে আসক্ত। বিএটিবি-এর জন্য প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয় (বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষণা, ২০২২)। এই জমিতে যদি ধান চাষ হতো, তাহলে প্রায় ১ দশমিক ৮ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন সম্ভব হতো, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারত। তামাকচাষে বেশি সেচ, সার ও কীটনাশকের দরকার হয়, যা জমির দীর্ঘমেয়াদী উর্বরতা নষ্ট করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে। এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, তামাকজনিত রোগে চিকিৎসা ব্যয় প্রতি বছর ত্রিশ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়, যা জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটের বড় অংশ গ্রাস করে। বিএটিবি থেকে সরকার বছরে প্রায় ৮,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব পায়। তবে তামাকের কারণে দেশের যে পরিমাণ স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ক্ষতি হয়, তা রাজস্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।

ডিওএইচএস আবাসিক এলাকার বিএটিবি কারখানার প্রভাব

মহাখালীর ডিওএইচএস একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা, যেখানে কোনো বাণিজ্যিক বা শিল্প কার্যক্রম পরিচালনা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। অথচ বিএটিবি ১৯৮০-এর দশক থেকে এই এলাকায় তাদের হেড অফিস স্থাপন করে। অফিসটিতে শুধু প্রশাসনিক কাজই নয়, একাধিক ল্যাবরেটরি, গবেষণা ইউনিট, বিপণন ও বিতরণ বিভাগও সক্রিয় রয়েছে। এখানে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণে নানা ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার হয় যার ফলে বায়ুতে থাকে নিকোটিন ও টার, ভোকিং গ্যাস ও ধোঁয়া, বিশেষ ধরণের শিল্প বর্জ্য। এগুলো সরাসরি মানুষের শ্বাসযন্ত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। WHO অনুসারে, তামাক কারখানার ১ কিমি এলাকার শিশুদের মধ্যে শ্বাসজনিত রোগের ঝুঁকি ৪ গুণ বেশি। পানি ও মাটি দূষণ যেমন তামাকের অবশিষ্টাংশ এবং রাসায়নিক বর্জ্য যদি সঠিকভাবে নিষ্কাশন না হয়, তাহলে তা আশেপাশের জলাধার ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দূষিত করে, মাটি দূষণ করে, যা পার্শ্ববর্তী গাছপালা ও বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি করে। খাদ্যচক্রে বিষক্রিয়া ঘটে।

ডিওএইচএস এর কারখানায় ২৪ ঘণ্টা পণ্য প্রবেশ ও বিতরণ চলে। ভারী ট্রাক, কন্টেইনার বহনকারী যান চলাচল করে। শব্দ ও যানজট সমস্যা যেমন কারখানার লজিস্টিক, লোডিং-আনলোডিং ও পণ্য পরিবহনের কারণে। ট্রাক ও ভারী যানবাহনের চলাচল বেড়ে যায় এবং শব্দ দূষণ ও ট্র্যাফিক জ্যাম তৈরি হয় যা বাসিন্দাদের মানসিক চাপ ও জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর ধারা অনুযায়ী, কোনো আবাসিক এলাকায় পরিবেশ-ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম নিষিদ্ধ। অথচ বিএটিবি বার্ষিক পরিবেশ ছাড়পত্র পেয়েছে, যদিও তাদের কার্যক্রমের প্রকৃতি আবাসিক এলাকায় নিষিদ্ধ থাকার কথা। ২০২১ সালে বেলা হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে বিএটিবি-এর কার্যক্রমকে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘন ঘোষণা করার দাবি জানানো হয়। হাইকোর্ট বিএটিবি কে নোটিশ পাঠালেও মামলার শুনানি বারবার পিছিয়ে যায়। এটিকে ‘স্টেট কর্পোরেট ক্যাপচার’-এর প্রমাণ হিসেবে দেখা হয়, যেখানে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা কর্পোরেট চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

ডিওএইচএস এর মতো অভিজাত এলাকায় প্রাণঘাতী এবং পরিবেশ দূষণকারী একটি কারখানায় আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০১৭ সালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (DNCC) তদন্ত প্রতিবেদন থেকে। এরপর ২০১৮ ও ২০১৯ সালে DNCC দুইবার উচ্ছেদের নোটিশ জারি করেও কার্যকর করা হয়নি। বিএটিবি -এর কার্যালয়ে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তবুও পরিবেশ অধিদপ্তর বিএটিবি-কে নিয়মিত ছাড়পত্র দিয়ে আসছে, যা তাদের নিষ্ক্রিয়তা ও সহনশীলতার প্রমাণ। কারখানাটি সরিয়ে নেয়ার জন্য কিছু নাগরিক উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম ২০০৯, ২০১৬ ও ২০২২ সালে স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে DOE-তে অভিযোগ দায়ের করা হয়। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও সেনা কল্যাণ বোর্ডে চিঠিপত্র ও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।

উল্লেখ্য, বিএটিবি কেবল একটি তামাক কোম্পানি নয়; এটি এখন একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে প্রবল প্রভাব বিস্তারকারী বহুজাতিক শক্তি। স্বাস্থ্যক্ষতির দায়, কৃষিজমির অপব্যবহার, অর্থনৈতিক মুনাফা পাচার, সামাজিক অনৈতিকতা ছড়িয়ে দেওয়ার পরেও তারা কিভাবে একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে, তার উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায়, নীতিনির্ধারকদের একাংশ এই কর্পোরেট বলয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছেন। কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, রাজনীতিবিদ, এবং এমনকি অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা এই কোম্পানির পক্ষে কাজ করেছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে, বিএটিবি-এর বোর্ডে ও পরামর্শক কমিটিতে সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, আমলা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যুক্ত থাকায়, স্থানীয় প্রশাসন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দ্বিধায় পড়ে। অনেক উচ্চ পদস্থ সিভিল এবং সামরিক প্রশাসনের কর্তা ব্যাক্তিদের সন্তান এবং নিকট আত্মীয়রা এই প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে চাকুরি করছেন। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে অনেক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব।

ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো মূলত যুক্তরাজ্যভিত্তিক হলেও এর মালিকানার অংশবিশেষ আমেরিকান অংশীদারদের হাতে। বিশ্ববাজারে এর বিশাল প্রভাব রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে বিএটি এর পিছনে ব্রিটিশ সরকার ও আমেরিকান বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ থাকায়, কোম্পানিটির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকার একধরনের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপে থাকে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও ব্রিটিশ হাইকমিশনের পৃষ্ঠপোষকতা থাকার অভিযোগও বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে উঠে এসেছে।

উত্তরণে  করণীয়

মহাখালী ডিওএইচএস-এর মত একটি পরিকল্পিত অভিজাত আবাসিক এলাকার ভেতরে বা সংলগ্ন এলাকায় তামাক পণ্যের কারখানা কার্যক্রম চালানো শুধু স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকিই নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন এবং নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত নীতিমালার সাথে স্পষ্ট বিরোধপূর্ণ এবং এটি একটি নিরীহ ও নিরাপদ জীবনযাপনের সাংবিধানিক অধিকারেরও লঙ্ঘন। এই প্রতিষ্ঠানটি এখান থেকে এখনই উচ্ছেদ প্রয়োজন। এরজন্য করনীয়ঃ

প্রথমত, আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে এই কারখানা অপসারণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা যায়। ২০০৩ সালের Framework Convention on Tobacco Control (FCTC), যা বাংলাদেশ ২০০৪ সালে অনুসমর্থন করে, তাতে বলা হয়েছে যে তামাক উৎপাদন ও বিপণনের সমস্ত প্রক্রিয়া জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশকে বিবেচনায় রেখে পরিচালনা করতে হবে। এছাড়া WHO-এর পরিবেশবান্ধব নগর উন্নয়ন নির্দেশিকায় আবাসিক এলাকার নিকটে উচ্চমাত্রার দূষণকারী শিল্প স্থাপনার বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেওয়া হয়েছে। সুতরাং, আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য নীতি ও পরিবেশ-সংরক্ষণ চুক্তিগুলো বিএটিবি-এর মত কারখানার অবস্থান আবাসিক এলাকায় অনুপযুক্ত বলে গণ্য করে।

দ্বিতীয়ত, দেশীয় আইনের আলোকে বলা যায় যে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক এবং সেটি এলাকার প্রকৃতি অনুযায়ী হতে হবে। মহাখালী ডিওএইচএস একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিচালিত হয়। আবাসিক এলাকায় পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়া এবং Detailed Area Plan (DAP)-এর অনুমোদন ব্যতীত এ ধরনের বাণিজ্যিক বা শিল্প কারখানা চলা আইনগতভাবে অবৈধ। উপরন্তু, বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত “জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মপরিকল্পনা (২০২১–২০৪০)” অনুযায়ী, ধাপে ধাপে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনায় এমন স্থাপনাগুলোর অপসারণ প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত।

তৃতীয়ত, এরকম কারখানা অপসারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে। যেমন, ভারতের দিল্লি শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে ১৯৯০-এর দশকে বিভিন্ন শিল্পকারখানা, বিশেষত পরিবেশ দূষণকারী শিল্প ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সরিয়ে নেওয়া হয়। থাইল্যান্ডে ব্যাঙ্ককের অভিজাত এলাকায় একটি তামাক কারখানা জনগণের দাবিতে এবং জনস্বাস্থ্য হুমকির কারণ দেখিয়ে স্থানান্তর করা হয়। কানাডার তামাক কারখানা শুধু অনুমোদিত শিল্প অঞ্চলে, অস্ট্রেলিয়া শহরের বাইরে তামাক অঞ্চল নির্ধারণ, ইন্দোনেশিয়া আবাসিক এলাকায় তামাক কারখানার লাইসেন্স বাতিল এবং আইন প্রয়োগে কঠোরতা অবলম্বন করে। ফ্রান্সে তামাক প্রক্রিয়া শহরের বাইরে বাধ্যতামূলক এবং WHO মান রক্ষা করে। অনেক দেশে তামাক শিল্পকে শহর থেকে ২০-৩০ কিমি দূরে স্থানান্তর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে আমরা এখনও আইন প্রয়োগে দ্বিধাগ্রস্ত।

চতুর্থত, বাংলাদেশেও পরিবেশ দূষণের দায়ে ২০১৭ সালে হাজারীবাগ ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর, তেজগাঁও গার্মেন্টস ও প্রিন্টিং কারখানা উত্তরা, সাভার এবং আশুলিয়ায় স্থানান্তর এমনকি নামমাত্র পরিবেশদূষণকারী ওষুধ কারখানাও আবাসিক এলাকা থেকে সরে গেছে। গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকায় বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণকারী একটি কারখানা পরিবেশ অধিদফতরের নির্দেশে বন্ধ করে দেয়ার উদাহরন রয়েছে। অথচ ডিওএইচএস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ও পরিবেশ আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে স্থানীয় স্কুলে শিক্ষার্থীদের রোগবিস্তার সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও পরিবেশ অধিদফতরে অনেক বার স্মারকলিপি প্রদান করার পরেও কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।

এই বাস্তবতা ও দৃষ্টান্তের আলোকে, মহাখালী ডিওএইচএস থেকে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশের কারখানাটি সরিয়ে নিতে সরকার, স্থানীয় বাসিন্দা, সিভিল সোসাইটি ও পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোর সুপরিকল্পিত এবং সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। বিশেষ করে গাজীপুর, আশুলিয়া বা কেরানীগঞ্জের নির্ধারিত শিল্প অঞ্চলে বিএটি এর কারখানা স্থানান্তরের বাস্তব পরিকল্পনা নিয়ে ধাপে ধাপে স্থানান্তর করার উদ্যোগ নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে, সরকারকে “তামাকমুক্ত বাংলাদেশ ২০৪০” পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের সব তামাক শিল্প আবাসিক এলাকার বাইরে পরিকল্পিত শিল্প অঞ্চলে সরিয়ে নেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে রোডম্যাপ প্রকাশ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এইভাবে, মহাখালীর মত একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক অঞ্চলকে স্বাস্থ্যঝুঁকি, পরিবেশগত বিপর্যয় ও সামাজিক বিরোধ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং বাংলাদেশ তার আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি ও স্থানীয় আইন কার্যকর করার মাধ্যমে জনস্বার্থ রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করতে পারবে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট।