আবেগঘন প্রত্যাবর্তনে লক্ষ জনতার ভালোবাসায় সিক্ত খালেদা জিয়া

প্রকাশিতঃ 6:05 pm | May 06, 2025

রাইসুল ইসলাম খান, কালের আলো:

ঠিক চারমাস আগে যখন যুক্তরাজ্যে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তখনই ছড়িয়ে পড়ে গুজব। দেশের মাটিতে তিনি আর রাজনীতি করবেন না, ফিরবেন না দেশেও। একধাপ এগিয়ে কেউ কেউ বলতে থাকলেন, খালেদা জিয়া শিকার হলেন মাইনাস টু ফরমুলার। কিন্তু সব গুজব, সন্দেহ-সংশয় আর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তিমির হননের রাজনীতিক, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফিরলেন দেশে। রাজকীয় মর্যাদায় চিকিৎসা শেষে মঙ্গলবার (০৬ মে) তিনি দেশে ফেরেন কাতারের আমিরের দেওয়া একটি বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে। এই প্রত্যাবর্তন স্বভাবতই আবেগঘন। লক্ষ জনতার জোয়ারে ভালোবাসায় সিক্ত হলেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনীতির ঐক্যের প্রতীক বেগম জিয়া। অভূতপূর্ব এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেন তাঁর সঙ্গে দেশে আসা দুই পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামিলা রহমানও। এ যেন দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয়-অভাবনীয়-অনির্বচনীয় দিন।

এর আগে মঙ্গলবার (৬ মে) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে তাকে বহন করা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপর তিনি পৃথক একটি গাড়িতে উঠে হ্যাঙ্গার গেট দিয়ে বের হন। বিমানবন্দরে নামার পর বেগম জিয়াকে স্বাগত জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ সময় বিএনপির স্থায়ী ও নির্বাহী কমিটির অন্যান্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। পরে কড়া নিরাপত্তার সঙ্গে তিনি বিমানবন্দর থেকে বের হন। দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে গুলশানের ফিরোজা ভবনে পা রাখেন। দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে শুভেচ্ছায় সিক্ত হতে হতে গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজায়’ পৌঁছাতে খালেদা জিয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যায়। প্রিয় নেত্রীর প্রত্যাবর্তনে গণতন্ত্র আবার আশার আলো দেখছে বলে মন্তব্য করেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। বিএনপি চেয়ারপারসনের ঢাকায় পৌঁছানোর আগে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিমানবন্দরের সামনে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা গণতন্ত্রের উত্তরণের পথকে সহজ করবে। আজ দেশের জন্য ও জনগণের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিন।’

জনপ্রিয়তা ও সমর্থনের জানান দিলো বিএনপি, দ্রুত নির্বাচনের দাবি কর্মীদেরও
বিমানবন্দর থেকে গুলশান ১০ কিলোমিটার পথজুড়ে লাখো নেতাকর্মী ও জনতার সমাবেশ ঘটিয়ে জনপ্রিয়তা আর সমর্থনের জানান দিল দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। এসময় সড়কের পাশে অবস্থান নেওয়া হাজার হাজার নেতাকর্মী জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা হাতে নিয়ে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানায়। বিএনপি নেত্রী গাড়ি থেকে হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছার জবাব দেন। বিমানবন্দর থেকে ‘ফিরোজা’ পর্যন্ত নেত্রীকে বরণ করে নিতে ‘খালেদা জিয়ার আগমন, শুভেচ্ছার স্বাগতম’; ‘তারেক জিয়া বীরের বেশে, আসবে ফিরে বাংলাদেশে’; ‘খালেদা জিয়ার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’সহ বিভিন্ন স্লোগান ধরেন নেতাকর্মীরা।

  • রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয়-অভাবনীয়-অনির্বচনীয় আনন্দের দিন
  • জনপ্রিয়তা ও সমর্থনের জানান দিলো বিএনপি, দ্রুত নির্বাচনের দাবি কর্মীদেরও
  • ধীরে ধীরে হেঁটে ফিরোজায় প্রবেশ করেন খালেদা জিয়া, বিশেষ রান্নায় জিয়ার বাবুর্চি
  • কাতার আমিরকে ধন্যবাদ, শিগগির দেশে ফিরবেন তারেক রহমান

বাংলাদেশের ৫৪ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে আপোসহীন খেতাবে ভূষিত বেগম জিয়াকে বরণ করে নিতে এদিন ভোরের আলো ফোটার পর থেকেই থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিমানবন্দর সড়কে জড়ো হতে শুরু করেন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের খিলক্ষেত, কুর্মিটোলা, বনানী, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে অবস্থান নেন। তারা পিকআপ কিংবা বাসে করে গান বাজাতে-বাজাতে দলের পতাকা, দেশের পতাকা নিয়ে উপস্থিত হন সড়কে। কেউ-কেউ মাথায় দলের পতাকা লাগিয়ে আসেন। কারো হাতে শোভা পায় দলীয় ব্যানার, ফেস্টুন। কোনো কোনো গ্রুপ আসেন ব্যান্ডপার্টি নিয়ে। খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা উপলক্ষে নেতাকর্মীদের ভিড় সামলাতে ঢাকা মহানগর পুলিশও বিমানবন্দর সড়কে যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ করার কথা জানায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচলের সুযোগ রাখা হয়। ঢাকা সেনানিবাসের রাস্তায় হালকা যানবাহন চলাচলের সুযোগও থাকে। জনসাধারণকে এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গুলশান-বনানী থেকে উত্তরা পর্যন্ত সড়ক যথাসম্ভব পরিহার করে বিকল্প রাস্তায় চলাচলের অনুরোধ করা হয়। বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীদের অবস্থানের ফলে কোনো পূর্ব নির্দেশনা না থাকলেও ‘বাধ্য হয়ে’ বনানী থেকে গুলশানগামী সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সড়কের কোথাও কোথাও দাঁড়িয়ে দলীয় নেতাকর্মীরা ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ স্লোগানে আকাশ ভারী করে তোলেন। একনজর নেত্রীকে দেখতে ছুটে আসা কর্মীদের কণ্ঠে ছিল আবেগ। দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেক কর্মী চোখে পানি নিয়ে বলছেন, ‘আমরা মা’কে দেখতে এসেছি। উনার জন্য দোয়া করি যেন তিনি সুস্থ থাকেন এবং আবার রাজপথে নেতৃত্ব দেন।’ চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতিতে তৈরি হয় উৎসবমুখর এক পরিবেশ। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কর্মীরা বলেন, ‘সকাল থেকেই অপেক্ষা করছি। আমার নেত্রীকে একবার শুধু দেখতে চাই। এরচেয়ে বড় আর কোন ইচ্ছা নেই।’ খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে নেতাকর্মীদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে বিএনপির চেয়ারপারসনের সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ) সদস্যদেরও।

ফিরোজার সামনের সড়কেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী ছিল। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাবের সদস্যরা তৎপর থাকলেও নেতাকর্মীদের আবেগ থামানো যায়নি। হেঁটে হেঁটে কেউ এসেছেন টঙ্গী থেকে, কেউ বা নারায়ণগঞ্জ থেকে। ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড থেকে হাজারো মানুষ এসে দাঁড়িয়েছিলেন সড়কের মোড়ে মোড়ে।

খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে ময়মনসিংহ থেকে এসেছিলেন নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এই অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে দ্রুত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে সরে যাওয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে এবং খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই।’ পাশেই দাঁড়ানো আরেকজন বলেন, ‘বিএনপি একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। অনেক বছর দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। আশা করছি এ সরকার দ্রুত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে। এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবেন খালেদা জিয়া।’

রাজধানীর হোটেল লা মেরিডিয়ানের সামনে কথা হয় পানি বিক্রেতা শ্যামলী বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া আইবে এজন্য এত লোক আজ। আমরা বিএনপির লোক, বিএনপিরে ভোট দিমু।’ রাজধানীর ক্ষিলখেত এলাকার চা দোকানি হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এয়ারপোর্ট ও এই রাস্তায় এত লোক আগে কখনো হয়নি। খালেদা জিয়া একজন জনপ্রিয় নেত্রী, তার জন্যই এত মানুষ এসেছে। তিনি আমাদের দেশের একমাত্র নেত্রী, তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই।’

ধীরে ধীরে হেঁটে ফিরোজায় প্রবেশ করেন খালেদা জিয়া, বিশেষ রান্নায় জিয়ার বাবুর্চি
দীর্ঘদিন ধরে নানান শারীরিক জটিলতায় ভুগতে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জনসমক্ষে সাধারণত হুইলচেয়ারে দেখা গেছে। কিন্তু এদিনের চিত্র ছিল ভিন্ন। দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে গুলশানের ফিরোজা ভবনে পা রাখেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়া। এরপর গাড়ি থেকে নেমে পুত্রবধূসহ অন্যদের সহায়তায় ধীরে ধীরে হেঁটে বাসায় প্রবেশ করেন। দীর্ঘদিন পর দলীয় প্রধানকে হাঁটতে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন নেতাকর্মীরা।

অনেকেই বলছেন, খালেদা জিয়ার পায়ে হেঁটে বাসায় প্রবেশ শুধু তার শারীরিক উন্নতির প্রতীক নয়, বরং একটি আত্মবিশ্বাসী প্রত্যাবর্তনের বার্তাও হতে পারে। বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, ‘ম্যাডাম আজ নিজে হেঁটে ফিরোজায় ঢুকেছেনÑএটাই আমাদের কাছে অনেক বড় প্রেরণা। তিনি লড়াকু ছিলেন, আছেন, থাকবেন।’ এ সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বড় পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান, ছোট পুত্রবধূ সৈয়দা শামিলা রহমান এবং চিকিৎসকসহ একটি প্রতিনিধিদলকে দেখা যায়। এই প্রত্যাবর্তনের প্রতিটি মুহূর্ত দলীয় নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ‘নেত্রী ফিরেছেন, নেত্রী হেঁটে এসেছেন’-এই বার্তায়।

দীর্ঘদিন পর দুই পুত্রবধূকে নিয়ে দেশে ফেরা উপলক্ষে খালেদা জিয়ার ঢাকার গুলশানের বাসভবনে আয়োজন করা হয় বিশেষ ভোজের। মঙ্গলবার (৬ মে) বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত বাবুর্চি এই বিশেষ ভোজের আয়োজন করেন। জিয়াউর রহমান স্যারের সময় থেকে যিনি রান্না করতেন, তিনিই আজ রান্না করেছেন। তবে, শায়রুল কবির খান বিশেষ ভোজের মেন্যু সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, আজ বিশেষ কোনো রান্না আছে কি না, সেটা বলা যাচ্ছে না।

কাতার আমির ধন্যবাদ, শিগগির দেশে ফিরবেন তারেক রহমান
দেশে পৌঁছে কাতার সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় পৌঁছে তিনি কাতার সরকারের প্রতি এই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, কাতার সরকার শুধু এয়ার অ্যাম্বুলেন্সই প্রদান করেনি বরং বিমানের খরচ, ওষুধ এবং চিকিৎসা সেবার সবকিছু নিশ্চিত করেছে। এই সহায়তার জন্য খালেদা জিয়া কাতার সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, কাতার সরকার খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য সবকিছু নিশ্চিত করেছে এবং এই মানবিক সহায়তা দেশনেত্রীর সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, আমরা আশা করছি খুব শিগগির এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে যেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দেশে ফিরে জাতির নেতৃত্বে যোগ দিতে পারেন। তিনি আরও বলেন, যিনি বেগম জিয়াকে তাচ্ছিল্য করেছিলেন, তিনিই আজ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পক্ষান্তরে বেগম জিয়া আজও এখানেই আছেন, জাতির নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। তারেক রহমানের দেশে ফেরার জন্যও বিএনপি অনেকটাই আশাবাদী।

বিএনপির পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে, যারা খালেদা জিয়ার দেশে প্রত্যাবর্তনে সহায়তা করেছে। ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, যেসব সংস্থা মানবিক অবস্থান থেকে সহযোগিতা করেছে, তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা।

কালের আলো/আরআই/এমএএএমকে