দেশের হকিতে প্রাণের ছোঁয়া, বীর যুবাদের রাজসিক বরণ

প্রকাশিতঃ 8:37 pm | December 05, 2024

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

অবিশ্বাস্য বা কোন রূপকথা নয়। একেবারেই বাস্তব। প্রথমবারের মতো হকির কোন বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ওমানের মাসকাটে এশিয়ান অনূর্ধ্ব-২১ হকিতে থাইল্যান্ডকে ৭-২ গোলে উড়িয়ে যুব বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত করেছে দেশটি। ওইদিনই দেশের হকির আকাশে চাঁদ হয়ে দেখা দিয়েছিল বীর যুবারা। অনেক আরোধ্যের এমন অর্জনে শুরু হয়েছে রীতিমতো উৎসব। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বৃহস্পতিবার (০৫ ডিসেম্বর) আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বাস। অপেক্ষা করছিল যুব খেলোয়াড়দের জন্য।

সেই বাসে করে রাজধানীর বিমান বাহিনীর ঘাঁটি বাশারের ফ্যালকন হলে যান খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফরা। সেখানে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের পক্ষ থেকে খেলোয়াড়দের দেওয়া হয় সংবর্ধনা। তাদের প্রত্যাবর্তনের গল্প পৌঁছে গেছে সবার কানে কানে। সবার মুখে একটিই কথা- ‘বাংলাদেশ!’ ‘বাংলাদেশ!’ লাল-সবুজের বিজয় নিশান ছড়িয়ে গেছে হাতে হাতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে যাঁর মতো করে ভিডিও-ছবি দিয়ে দেশবাসীকে জানান দিয়েছেন- ‘বাংলাদেশও পারে’।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের (বাহফে) সভাপতি ও বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান নিজের বক্তব্যে যুবাদের অর্জনে জানালেন খুশির কথা। বললেন- ‘তোমাদের এই সাফল্যে দেশবাসী গর্বিত। আমাদের মূল লক্ষ্য সিনিয়র বিশ্বকাপে খেলা।’ বাংলাদেশের অনেক খেলায় খেলোয়াড়দের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও নানা সমস্যা প্রকাশ্যে আসে। যুব হকি খেলোয়াড়দের সেসব থেকে দূরে থাকার পরামর্শ সভাপতির, ‘সব সময় টিম হয়ে থাকবে। কোনো বদ অভ্যাসের সঙ্গে জড়াবে না, সর্বদা শৃঙ্খলা বজায় চলবে’-পরামর্শে বলেন বাহফে সভাপতি।

যুব এশিয়া কাপে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করা রাকিবুল হাসান রকিদের এমন অর্জনে এক হয়েছে দেশ। হকি, ফুটবল, বা ক্রিকেট-খেলা যা–ই হোক, এই সাফল্য যেন পুরো বাংলাদেশের। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২১ হকি দলকে রাজসিক কায়দায় বরণের এমন আয়োজন বা আনন্দ সর্বজনীন হয়ে ‘এক’ করেছে গোটা দেশকে। বিশ্বকাপ নিশ্চিত করা খেলোয়াড়দের সঙ্গে ফেডারেশনের প্রধান কর্তা থেকে শুরু করে অন্যান্যরাও ফটোসেশন করেছেন। প্রত্যেকের গলায় পরিয়ে দেওয়া হয় ফুলের মালা। ফেডারেশনের পক্ষ থেকে প্রদান করা হয় ৫ লাখ টাকার আর্থিক পুরস্কারও।

যুব বিশ্বকাপেই পূর্ণ মনোযোগ বাহফে সভাপতির
মহান বিজয়ের মাসে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২১ হকি দলের অভাবনীয় অর্জন হকিপাগল জনতাকেও করেছে আপ্লুত। স্বভাবতই বীর যুবাদের মুখেও হাসির ঝলক। তাতে আড়াল হয়েছে লম্বা ভ্রমণের ধকলও। হকিতে প্রথমবারের মতো বিশ^মঞ্চে টাইগারদের আবির্ভাব রাজধানীর ফ্যালকন হলের ভেতর-বাহির করে তুলে আরও রঙিন। খেলোয়াড়দের সংবর্ধনা প্রদান শেষে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন ফেডারেশন বাহফে সভাপতি ও বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান। এবার তাঁর পূর্ণ মনোযোগ আগামী বছর ডিসেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য যুব বিশ্বকাপকে ঘিরেই। এজন্য এই দলটিকে আগে থেকেই আরও বেশি সময় অনুশীলনে রাখতে চান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের টেকনিক্যাল কমিটিতে যারা আছেন তারা আমাদের উপদেশ দিবেন, আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করব। প্রয়োজন হলে প্রয়োজন হলে বাইরে থেকে কোচ নিয়ে আসবো। বর্তমান যুগের হকি অনেক পরিবর্তিত। টেকনিক্যাল থেকে অনেক ফিজিক্যাল হয়ে গেছে খেলাগুলো অনেক ফাস্ট হয়ে গেছে। ওদের সঙ্গে কমপ্লিট করতে হলে আমাদের অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে।’

উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে প্রত্যাশার পারদ চড়িয়ে তিনি বলেন- ‘প্রথমবার আমরা যুব বিশ্বকাপে খেলব। প্রথমেই বিশ্বকাপ জয়ের প্রত্যাশা বাস্তবিক হবে না। আমরা আমাদের যথাসাধ্য ভালো পারফরম্যান্সের প্রত্যাশা করব। এবার তিন মাসের মতো অনুশীলন হয়েছে। বিশ্বকাপের আগে এক বছর সময় রয়েছে যা যথেষ্ট। আমরা অন্তত মাস ছয়েকের অনুশীলনের ব্যবস্থা করবো। আমরা নিজেদের সেরাটা দিয়ে তাদেরকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করবো।’

তাঁর প্রত্যাশা আরও এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের হকি
দুরন্ত জীবনের উষা লগ্নে খেলার মাঠেও তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। ক্রিকেটের পাশাপাশি খেলেছেন বাস্কেটবলও। ফলে দু’টি খেলাতেই রয়েছে বাহফে সভাপতির বাস্তব এক অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়ে নতুন এক উচ্চতায় তিনি নিয়ে গেছেন বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনকে (বাহফে)। বাংলাদেশ হকি দলের দুর্বলতার নানা দিকও সনাক্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলেরও উন্নতির জায়গা থাকে। আমাদের তো অবশ্যই রয়েছে। বিশেষ করে পেনাল্টি কর্নার ও পেনাল্টিতে (পেনাল্টি স্ট্রোক) আমাদের আরও ভালো করতে হবে।’ বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য বিদেশি কোচ, বিদেশে অনুশীলনও প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে রকিদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনে বিদেশি কোচ আনার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাহফে সভাপতি।

যুব হকি দল ক্যাম্প চলাকালে মাত্র ৪০০ টাকা ভাতা পায়। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে যা খুবই কম। ভাতা ছাড়াও খেলার সরঞ্জাম এবং আরও অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে খেলোয়াড়দের। সভাপতি খেলোয়াড়দের সামগ্রিক সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমরা অবশ্যই আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করব খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য।’

বাংলাদেশের হকিতে সাফল্যের বিচারে একটা পর্যায়ের পর আর আগাতে পারছে না। এই সমস্যার সমাধান কিভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে হকি ফেডারেশনের সভাপতি বলেন, ‘আমি ইতিহাস বিশ্লেষণ করে সময় নষ্ট করি না, আমি ফ্রেশ স্টার্ট করি। আমাদের ছেলেরা আমাদের দারুন একটি সুযোগ করে দিয়েছে যেন আমরা নতুন করে এগিয়ে যেতে পারি আমরা সেই সুযোগটা সদ্ব্যবহার করবো। ফেডারেশনের সহযোগিতায় আমরা অবশ্যই এটা চেষ্টা করবো।’

হকি ফেডারেশনে এখন অ্যাডহক কমিটি। এই কমিটির ওপর আস্থা রেখে এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেন, ‘বর্তমান কমিটির শুধু একটি লক্ষ্য হকিকে এগিয়ে নেওয়া। আশা করি হকি সামনে আরও এগিয়ে যাবে। ফেডারেশনের এই মুহূর্তে যেমন ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল সাপোর্ট দরকার সেটা একটু দুর্বল তবে সেটা দূর করতে আমরা চেষ্টা করবো। বারবারই বলেছি আমাদের মেইন যারা তারা হচ্ছে আমাদের খেলোয়াড় তাদেরকে আমাদের ঠিক রাখতে হবে। তারা যদি ঠিক থাকে তাহলে অটোমেটিক্যালি আমরা ভালো করতে পারবো। হকি ফেডারেশনে আগে যে বাধাগুলো ছিল এখন আর সে বাধাগুলো নেই। আমাদের এখন একটাই চিন্তা হকের উন্নতি।’

দ্রুত ক্যাম্প শুরুর তাগিদ সর্বোচ্চ গোলদাতা রকির
যুব এশিয়া কাপে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করেছেন রাকিবুল হাসান রকি। আসরে তিনি সাত গোল করেছেন। নিজের পারফরমেন্সে সন্তুষ্ট হলেও আরো বেশি গোল করতে পারতেন বলে মনে করেন তিনি। যুবদলের খেলার আগে সিনিয়র দলের হয়েও খেলেছেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা যুবদলের চাপ সামলে নিতে কাজে দিয়েছে বলে মনে করেন রকি। গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, ‘এটা একটু চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিন্তু ন্যাশনাল টিমের পারফরমেন্স বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। ন্যাশনাল লেভেলও চ্যালেঞ্জিং এটাও চ্যালেঞ্জিং। তবে আমার মতে সিনিয়র লেভেল তো সিনিয়ার লেভেলই। ওইটা অনেক উপরের লেভেলে ইন্ডিয়ার সাথে খেলা মালয়েশিয়ার মতন দেশের সাথে খেলা। সিনিয়ার লেভেলে খেলার ফলে জুনিয়র লেভেলে খেলতে আমি একটু বেশি কনফিডেন্স পেয়েছি।’

‘আরও বেশি গোল হতে পারতো আমি অনেক ইজি গোল মিস করছি । পারফরম্যান্স আরো ভালো হতে পারতো তবে অল্প সময়ের মধ্যে যা করতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ আমি সন্তুষ্ট’-যোগ করেন তিনি। দ্রুতই ক্যাম্প শুরু করতে চান রকি। হাতে এক বছরের মত সময় থাকলেও দ্রুতই ক্যাম্প শুরু করে নিজেদের কাজে লেগে পড়তে চান তিনি। শুধু রকি নন সময়ক্ষেপণ করতে নারাজ সকলেই। রকি বলেন, ‘ফেডারেশনের কাছে একটাই চাওয়া যত তাড়াতাড়ি পারুক ফেডারেশন আমাদের ক্যাম্পটা শুরু করুক। আমরা ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে যাইতেছি আমাদের টক্কর দিতে হবে ওই লেভেলের দল দলের সাথে যেখানে নেদারল্যান্ড জার্মানির মতো দল থাকবে। আমাদের লেভেলটা হইতে হবে এরকম। যত তাড়াতাড়ি আমাদের ক্যাম্প শুরু হবে আমরা ভালো কোচিং স্টাফ ভালো ফ্যাসিলিটি ভাবো তত ভালো খেলা আমরা দেশকে দিতে পারব। আমার একটাই চাওয়া যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের ক্যাম্পটা শুরু হোক।’

কালের আলো/এমএএএমকে