যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রিস্টান

প্রকাশিতঃ 3:38 pm | November 30, 2024

মাহমুদ আহমদ:

বিশ্ব এখন এক দুর্যোগময় সময়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট প্রায় প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন ও গভীরতর বিপদের রূপ নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী যুগের সাথে এর তুলনা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে আর স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছে যে, ঘটনাবলি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুতগতিতে এক ভয়াবহ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে বিশ্বময় অরাজকতা, নৈরাজ্য, ধর্মের নামে রক্তপাত আর চলছে মাজহাবি যুদ্ধ। নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো মনে হয় এক ধরনের অলিখিত প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমাজের সব ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীর মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন রচনা করেছিলেন। তিনি (সা.) ছিলেন সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ। মানব চরিত্রে যত প্রকারের মহৎ গুণ থাকতে পারে তার চরিত্রে ও আদর্শে সে সব গুণ পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। ধর্ম প্রচারই বলুন আর পারিবারিক জীবনের অন্য কাজই বলুন না কেন মহানবি (সা.) তার স্বীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে আদর্শের উৎকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এজন্যই তিনি আসমান ও জমিনে সর্বত্রই সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হিসেবে স্বীকৃত। নিজ ধর্ম ইসলাম প্রচার ক্ষেত্রে তিনি কখনও জোর জবরদস্তি করেননি বরং কোরআনের শিক্ষা অনুযায়ী তার (সা.) অনুসারীদের প্রতি নির্দেশ ছিল ‘তোমরা কারও মতের ওপর বল প্রয়োগ করো না (সুরা বাকারা: ২৫৬)। বরং একথা বলবে, তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন আর আমার জন্য আমার দ্বীন (সুরা কাফেরুন)।

ধর্ম পালনের ব্যাপারে প্রত্যেকের স্বাধীন ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেবে। মানবতা লঙ্ঘন হয় যুদ্ধক্ষেত্রে এমন কোনো ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করবে না। যুদ্ধবন্দিদের প্রতি সহনশীল হবে। স্বীয় আদর্শের উৎকর্ষতার মাধ্যমে অন্য ধর্মাবলম্বীদের হৃদয় জয় করার চেষ্টা করবে। কেননা বলপ্রয়োগে কখনো স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এই নীতিই ছিল আমাদের প্রিয় নবীর (সা.)।

প্রকারান্তরে এ আদর্শের ওপর দৃঢ় প্রত্যয় ছিল বলেই সেদিন যে বিধবা মহানবির (সা.) কাছ থেকে শহর ছেড়ে পালিয়ে স্বীয় ধর্ম রক্ষার চেষ্টা করেছিল আর সেই বিধবারই ভারী বোঝা বহন করে কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়ে মহানবি (সা.) বলেছিলেন, হে বিধবা মা! আপনি যার ভয়ে নিজ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন আমিই সেই মুহাম্মদ। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দয়ার্দ্র ও অনুপম আদর্শের নমুনা দর্শনে বিধবা বিস্মিত হলেন, আপ্লুত হলেন, ইসলাম প্রচারকের অনন্য বৈশিষ্ট্যের রূপ দেখে বিমুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, তুমিই যদি সেই মুহাম্মদ হয়ে থাক তাহলে আমি তোমার প্রতি ইমান আনলাম।

তলোয়ার হাতে যে বেদুইন হজরত রাসুল (সা.) কে হত্যা করতে এসেছিল সেই নরাধম ঘাতককেও তিনি (সা.) সেদিন ক্ষমা করে দিয়েছিলেন অকাতরে। শুধু তা-ই নয়, মুসলমানদের প্রতি হিংসাপরায়ণ হয়ে যারা মুসলমানদের হত্যা করেছে, পৃষ্ঠদেশে জ্বলন্ত আগুনের ছেঁকা দিয়েছে, নাকে রশি ঝুলিয়ে তপ্ত বালুকায় পশুতুল্য আচরণে টানা-হেঁচড়া করেছে, কাউকে বা শহীদ করে তার কলিজা চিবিয়েছে, এমন নির্মম নিষ্ঠুর হৃদয়ের ইসলাম বিদ্বেষীকেও রহমতুল্লিল আলামিন হজরত মুহাম্মদ (সা.) ক্ষমা করে দিয়েছিলেন নিঃশর্তে।

আসুন, বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে রক্ষা করতে বিশ্বজুড়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করি আর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সাথে সম্প্রীতির বাধনে আবদ্ধ হই এবং দয়াসুলভ আচরণ করি। যেভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সব সৃষ্টিজীব আল্লাহর পরিবার। অতএব আল্লাহতায়ালার কাছে তার সৃষ্টজীবের মাঝে সে-ই প্রিয়ভাজন যে তার সৃষ্টজীবের সাথে দয়ার্দ্র আচরণ করে এবং তাদের প্রয়োজনের প্রতি যত্নবান থাকে’।

যেদিন সেই অত্যাচারীদের প্রতিশোধ নেওয়ার সমূহ সুযোগ ছিল সেদিনও তিনি (সা.) তা না করে বরং ক্ষমার উদাত্ত আহ্বানে বলেছিলেন, হে মক্কাবাসীগণ! আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই, তোমরা আজ সবাই আমার ক্ষমার চাদরে আচ্ছাদিত। ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে এ হলো মানবপ্রেমিক মহামানবের স্বর্ণোজ্জ্বল আদর্শ। মানবতা প্রতিষ্ঠার গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার জীবন দ্বারা একথা প্রমাণ করে গিয়েছেন যে, ধর্মের নামে কোনো অন্যায়-অবিচার নেই। সব ধর্মের সম্মানিত ব্যক্তি ও তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো শ্রদ্ধার বস্তু। মহানবি (সা.) সমাজের সর্বক্ষেত্রে এবং সকল জাতির মাঝে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।

যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করার যে শিক্ষা তা অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন এবং তার লিখনিতে তা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি লিখেছেন-
জাতি ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি।
তাইতো লিখতে পেরেছেন,
“গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিষ্টান।”
তিনি লিখেছিলেন-
“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।”

নজরুল যে কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তা ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধ থেকে আরো স্পষ্ট হয়। তিনি লিখছেন: “নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ-প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু, তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না। তার মন বলে, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি, আমারই মতো একজন মানুষকে।’

সকল ধর্মের সার্বজনীন মূল্যের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় আস্থা। ধর্ম নিয়ে আজ যারা বাড়াবাড়ি করে তারা আসলে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে অবস্থান করছে বলেই বিভিন্ন সময় ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করে। অথচ ইসলাম একটা ফলবতী গাছ ধ্বংস করতেও বারণ করে। ধর্ম মানুষকে স্বীয় প্রবৃত্তি দমন করার মাধ্যমে সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়েছে। ধর্ম মানুষকে মানুষের জন্য শান্তি কামনা করার শিক্ষা দিয়েছে।

তাই আসুন, বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে রক্ষা করতে বিশ্বজুড়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করি আর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সাথে সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ হই এবং দয়া সুলভ আচরণ করি। যেভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল সৃষ্টিজীব আল্লাহর পরিবার। অতএব আল্লাহতায়ালার কাছে তার সৃষ্টজীবের মাঝে সে-ই প্রিয়ভাজন যে তার সৃষ্টজীবের সাথে দয়ার্দ্র আচরণ করে এবং তাদের প্রয়োজনের প্রতি যত্নবান থাকে’। (মিশকাত)।

আল্লাহপাক আমাদেরকে জাতি ধর্ম, বর্ণ সকলের সাথে উত্তম চারণ করার তৌফিক দান করুন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।