রণক্ষেত্রে সক্ষমতা দেখালো দক্ষ বৈমানিকরা, একুশ শতকের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রত্যয় বিমান বাহিনী প্রধানের
প্রকাশিতঃ 10:30 pm | November 27, 2024
কালের আলো রিপোর্ট:
টাঙ্গাইলের রসুলপুরের ফায়ারিং রেঞ্জে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে চললো শক্তিমত্তা প্রদর্শনের অনন্য এক মহড়া। আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল রণক্ষেত্র। একের পর এক ঘাঁটি থেকে উড়াল দিচ্ছে মিগ ২৯, এফ-৭ বিজি, এফটি-৭, কে-৮ ডব্লিউ এর মতো শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টার। গোলা ও রকেট বর্ষণের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে নানা রণকৌশলে ব্যস্ত দক্ষ বৈমানিকরা। ঠিক যেন দেশের আকাশ সীমা রক্ষায় নিজেদের সর্বোচ্চ সক্ষমতার অনবদ্য এক দৃষ্টান্ত। তবে, বাস্তবে কোন যুদ্ধ লাগেনি। হামলাও করেনি কোন শত্রুপক্ষ। সার্বভৌমত্ব রক্ষার দৃপ্ত শপথে বলীয়ান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বার্ষিক গোলা ও রকেট বর্ষণ মহড়ার দৃশ্য ছিল এমনই।
বুধবার (২৭ নভেম্বর) বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এই মহড়া অবলোকন করেন বাহিনীটির প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন। বাংলার আকাশ নিরাপদ রাখতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে আরও শক্তিশালী ও অদম্য করে তোলাই মহড়ার মূল উদ্দেশ্য বলে জানান তিনি। বিমান বাহিনী প্রধান দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দেন দেশের প্রতি যেকোনো আঘাত প্রতিহত করার। এক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা বিমান বাহিনীর দায়িত্ব বলেও জানান তিনি। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, বিমানবাহিনী ২৪ ঘণ্টা র্যাডারের মাধ্যমে আকাশসীমা পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না, তবে একুশ শতকের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। তাঁর কথাতেই স্পষ্ট দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এক বিন্দুও ছাড় দেবে না বিমান বাহিনী।
সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানসহ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা বিমান বাহিনীর এই মহড়া উপভোগ করেন।
‘বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত’ মূলমন্ত্রে দীক্ষিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দক্ষতা, সক্ষমতা ও দুর্বলতা মূল্যায়নকল্পে নিয়মিতভাবে আকাশ প্রতিরক্ষা মহড়ার আয়োজন করে। এটি দেশের সময়োপযোগী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এসব মহড়ায় বিমান বাহিনীর বৈমানিকরা আকাশ থেকে ভূমিতে গোলাবর্ষণ, আকাশ থেকে আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ও পর্যবেক্ষণসহ আকাশ যুদ্ধের বিভিন্ন প্রকার রণকৌশল অনুশীলন করেন।
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, এক্সারসাইজ ফ্ল্যাশ পয়েন্ট বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন। এটি বাংলার আকাশকে শত্রু বিমানের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বৈমানিকদের যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া এই মহড়ার মাধ্যমে বৈমানিক ও গ্রাউন্ড কন্ট্রোলাররা নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ এবং যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা নির্ভুল ভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। যদিও বিমান বাহিনীর প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে আকাশকে শত্রু বিমানের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষা। তবে অন্যান্য বাহিনীকে ক্লোজ এয়ার সাপোর্ট প্রদান করাও অপরিহার্য কাজগুলোর মধ্যে একটি। এবারের মহড়ায় এএন-৩২ পরিবহন বিমান রশদ সরবরাহ, কার্গো ড্রপ ও এয়ারলিফট অপারেশন পরিচালনা করে। এছাড়াও এমআই-১৭, এডব্লিউ-১৩৯ ও বেল-২১২ হেলিকপ্টারসমূহ আকাশ থেকে ভূমিতে গোলা বর্ষণ, ক্লোজ এয়ার সাপোর্ট এবং অনুসন্ধান ও উদ্ধারে তাদের সক্ষমতা প্রদর্শন করে।
দেশের যেকোন প্রয়োজনে আমরা ২৪ ঘন্টা প্রস্তুত রয়েছি
মহড়া পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন বলেন, ‘বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান ভূমিকা হচ্ছে দিগন্তে, স্থলে এবং জলে আমাদের নিরাপত্তা এবং যেকোন ধরনের আঘাত প্রতিহত করা। এটি আমাদের মূলমন্ত্র। এছাড়া দেশের যেকোন প্রয়োজনে আমরা ২৪ ঘন্টা প্রস্তুত রয়েছি। এই মহড়ায় আমাদের বিমান বাহিনীর যেসব সক্ষমতা রয়েছে সেগুলো আমরা প্রদর্শন করেছি। ফাইটার, ট্রান্সপোর্ট ও হেলিকপ্টার- তিন ধরনের সক্ষমতা
আমাদের বৈমানিকদের রয়েছে। আকাশ থেকে ভূমিতে গোলাবর্ষণ ছাড়াও ট্রুপস ইনসারশন, কমব্যাট এন্ড সার্চ রেসকিউ এবং সার্চ এন্ড রেসকিউ এবং আমাদের শান্তিকালীন সময়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় যে প্রস্তুতি দরকার সেই প্রস্তুতিও আমাদের রয়েছে। সেটিরও একটি প্রদর্শন হয়েছে আজ।’
তিনি বলেন, ‘এই ধরনের মহড়া আমরা শুধু প্রদর্শনের জন্যই করি না, আমাদের নিজস্ব একটি অ্যাসেসমেন্টও হয়, আমরা এখান থেকে বুঝতে পারি আমাদের আর কী ধরনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, আমাদের নিজস্ব প্রশিক্ষণের মানোন্নয়নের জন্য আর কী কী করণীয়, সেদিকে আমরা নজর দিতে পারি। কোভিড এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে এই মহড়া অনেকদিন পরে হয়েছে। এবার আমরা স্বল্প পরিসরে শুরু করেছি, ভবিষ্যতে আমাদের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি হবে, এই মহড়াগুলোকে আরও আধুনিকায়ন করে উন্নতভাবে পরিবেশন করতে পারবো।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সহায়তায় আরও উন্নত ধরনের সরঞ্জামাদির প্রত্যাশা
শান্তিকালীন বা যেকোন প্রয়োজনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী যেকোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত আছে বলে দেশবাসীকে আশ্বত করেন বিমান বাহিনী প্রধান। এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন বলেন, ‘একুশ শতকের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা আশা করছি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সহায়তায় আমরা বিমান বাহিনী আরও উন্নত ধরনের সরঞ্জামাদি পাবো এবং সেটির মাধ্যমে উত্তরোত্তর আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এই মহড়ার মাধ্যমে আমাদের প্রত্যেক পাইলটের ব্রিফিং হচ্ছে, আমাদের নিজস্ব এয়ার ক্রাফটের টেকনিক্যাল সাইড আমরা ঝালাই করতে পেরেছি, আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি হচ্ছে। আমাদের পাইলটদের দৈনন্দিন প্রশিক্ষণ সচল রয়েছে। প্রতিটি পাইলটের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে-যোগ করেন তিনি।
পঞ্চম প্রজন্মের মাল্টি রোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট নিয়ে আশাবাদী বিমান বাহিনী প্রধান
পঞ্চম প্রজন্মের মাল্টি রোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট নিয়ে আশাবাদী বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহরে সামরিক পরিবহন উড়োজাহাজ সি-১৩০জে যুক্ত হওয়ায় পরিবহন বিমানে আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের যেকোন প্রান্তে আমরা যেকোন সময় সহযোগিতা পাঠাতে পারি। ২০০০ সালে আমাদের চতুর্থ প্রজন্মের বিমান মিগ ২৯ এসেছিল। এরপর ২৪ বছর হয়ে গেছে। আমরা পঞ্চম প্রজন্মের মাল্টি রোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট (এমআরসিএ) বিশ্বের যেকোন প্রান্ত থেকেই হোক আমরা বিমান বাহিনীতে নিয়ে আসবো। আমাদের এয়ার ফোর্সের অন্যান্য ধরনের হেলিকপ্টার, সারফেজ টু এয়ার মিসাইল, মিডিয়াম সারফেজ টু এয়ার মিসাইল এই ধরনের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আমরা সচেষ্ট আছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এয়ার ডিফেন্স র্যাডারের মাধ্যমে আমরা ২৪ ঘণ্টা আমাদের আকাশ সীমা মনিটরিং এর মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং দেশে কোন ধরনের শত্রুবিমান প্রবেশ করলে আমরা ডিটেক্ট করতে পারি। কোন যুদ্ধে জড়িত হওয়া আমাদের উদ্দেশ্য না কিন্তু প্রয়োজন হলে আমরা সর্বদা প্রস্তুত আছি।’
কালের আলো/এমএএএমকে