দেড় বছরের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন, সেনাপ্রধানের ‘আশা জাগানিয়া’ বক্তব্যে ‘আশান্বিত’ দেশ
প্রকাশিতঃ 12:10 am | September 25, 2024
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর:
সামাজিক মানসে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘রাজনীতি’। বিশেষ করে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসীনের পর রাজনীতির অপরিহার্যতা তুলে ধরে একবার এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান যথার্থই বলেছিলেন-‘রাজনীতি ছিল, রাজনীতি থাকবে’। মাস দেড়েক আগে বিরাজনীতিকরণের আশঙ্কাকে ফুৎকারে উড়িয়ে খুলনায় সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে নতুন আশার মালা গেঁথে তিনি সুস্পষ্ট উচ্চারণে জানিয়ে দিয়েছিলেন-‘মিছিল হবে, মিটিং হবে। রাজনীতি থাকবে। সেখানে মানুষ কথা বলবে। তবে তা যেন ধ্বংসাত্মক না হয়। রাজনীতিবিদরা যেন জনগণের জন্য কাজ করেন।’
- ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন
- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না
- একসাথে কাজ করলে ব্যর্থ হওয়ার কোনও কারণ নেই
- রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য চান
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার রেজিমের অবসানের পর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুন:প্রবর্তনের সময়টিতেও ‘ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুন’ তত্ত্ব নিয়ে কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে এরপরেও সামনে নিয়ে আসেন অগণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশের বিষয়টিও। কিন্তু সেনাবাহিনীর কোন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নেই- নিজের সৎ, সাহসী, পেশাদার নেতৃত্ব ও দেশপ্রেমের নির্যাসে বারবার সেনাপ্রধান এটি বুঝানোর চেষ্টা করলেও স্বার্থচিন্তার সহজাত প্রবণতায় গা ভাসানো দ্বিমতকারীরা ভান করেছেন না বুঝার! যেহেতু রাজনীতি চর্চার একটি আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হলো নির্বাচন, তাই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য রোডম্যাপ নিয়েও কারও কারও মাথাব্যথা, মূল ভাবনা আর অযুত-নিযুত প্রশ্ন।
কিন্তু সঙ্কটে বিচক্ষণ, অত্যন্ত শান্ত ও ধীরস্থির সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আকুণ্ঠ দেশপ্রেমের বলিষ্ঠতায় সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন, দেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হবে আগামী দেড় বছরের মধ্যে। অনেকটাই সময়সীমা বেঁধে দিয়ে আর্ন্তাতিক বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না। আগামী দেড় বছরের মধ্যে দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণ হতে হবে।’ গত মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বার্তাসংস্থাটি। প্রতিবেদনটিতে সেনাপ্রধানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাজনৈতিকভাবে কোনও হস্তক্ষেপ করবে না। আমি এমন কিছু করব না যা আমার সংস্থার (সেনাবাহিনী) জন্য ক্ষতিকর হয়। আমি একজন পেশাদার সৈনিক। আমি আমার সেনাবাহিনীকে পেশাদার রাখতে চাই।’ গত সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিজের কার্যালয়ে রয়টার্সকে সাক্ষাৎকারটি প্রদান করেন সেনাপ্রধান।
গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনটিতে সেনাপ্রধানের ওঠে আসা বক্তব্যে ভেঙে গেছে প্রচলিত ধারণা। কারও কারও বহুল চর্চিত বয়ান-বিবৃতিও এখন পর্বতে মূষিক প্রসবের মতোই রূপ নিয়েছে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রস্ফুটিত হয়েছে সম্ভাবনার নতুন কলি। নির্বাচনের পথে অফুরান সম্ভাবনার নব দিগন্তে যাত্রার পূর্বে দেশের সঙ্কটে হাল ধরে, গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে তিনি পেয়েছেন প্রকৃত বীরের মর্যাদা। ছাত্র-জনতার শত শত প্রাণক্ষয়ের মর্মান্তিক অধ্যায়কে দীর্ঘায়িত না করে আরও রক্তবন্যার হাত থেকে দেশকে রক্ষা করে প্রমাণ করেছেন নিজের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও যোগ্যতার। রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাতকারে সাবলীলভাবে কোনোরকম আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে বাস্তবতার নিরিখে মানবিক রাষ্ট্র গড়ার মিশনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি তিনি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। দেশের মানুষের ভরসা ও বিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তি দেওয়ার একটি রূপরেখাও দিয়েছেন।
এই চার তারকা জেনারেল বলেছেন, ‘আমি তাঁর (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) পাশে থাকব। যাই হোক না কেন। যাতে তিনি তাঁর মিশন সম্পন্ন করতে পারেন।’ তাঁর সাহসী এবং বুদ্ধিদীপ্ত এমন উচ্চারণ এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। প্রকারান্তরে এর মাধ্যমে তিনি এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, জনগণের মঙ্গলই তার কাছে সবকিছু। সেনাপ্রধান স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আমি নিশ্চিত যে- আমরা যদি একসাথে কাজ করি তবে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনও কারণ নেই।’
রয়টার্সকে সেনাপ্রধান আরও বলেছেন, ‘সংস্কারের পর গণতন্ত্রে উত্তরণ এক বছর থেকে দেড় বছরের মধ্যে করা উচিত।’ তবে এই সময়ে ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে আমি বলব- এই সময়সীমার মধ্যেই আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করা উচিত।’
দেশ, জনগণ ও স্বচ্ছতার প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সেনাপ্রধানের সুদৃঢ় অবস্থানে আরও ব্যাপকভাবে আত্মবিশ্বাসী দেশের বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে সচেতন সাধারণ মানুষ। সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব, দক্ষতা, সততা, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার নজির স্থাপন করা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়া জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও আশা জাগানিয়া এমন উজ্জীবনী শব্দায়ন সচিবালয় থেকে শুরু করে অফিস পাড়া, গণমাধ্যম, কর্মক্ষেত্র, পরিবার থেকে সমাজ সর্বত্রই আলোচিত হচ্ছে; কুড়িয়েছে প্রশংসাও।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনায় গড়ে উঠা গৌরবময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিকেল থেকেই রাজধানীর মতিঝিল, ধানমন্ডি, মিরপুর, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়টার্সের সঙ্গে আলাপচারিতায় সেনাপ্রধানের এমন পথনির্দেশক সুস্পষ্ট জবাব নিয়ে নাগরিকদের ইতিবাচক আড্ডা-আলোচনা হয়েছে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে তাঁর পাশে থাকার পূর্ণ মানসিকতা দেশের সাধারণ মানুষকেও করেছে আশান্বিত।
প্রতিবেদনে রয়টার্স বলছে, বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং তার সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল উভয়ই গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছিল। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলছেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং তিনি (সেনাপ্রধান) প্রতি সপ্তাহে বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। অশান্তির পর দেশকে স্থিতিশীল করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।’
রয়টার্সের ভাষ্য হচ্ছে- শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রস্তাবিত ব্যাপক সরকারি সংস্কারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও তার সদস্যদের ইতোপূর্বে করা অন্যায়ের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে এবং ইতোমধ্যে কিছু সৈন্যকে শাস্তিও দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘যদি (সেনাবাহিনীর) কোনও কর্মরত সদস্য দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে অবশ্যই আমি ব্যবস্থা নেব। কিছু সামরিক কর্মকর্তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী (হাসিনা) বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোতে কাজ করার সময় অন্যায় কাজ করতে পারেন।’ জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে দূরে রাখতে চান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি সৈন্য রয়েছে এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অন্যতম প্রধান সেনা প্রেরণকারী হচ্ছে বাংলাদেশ। তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এটি (সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা) কেবল তখনই ঘটতে পারে যখন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার কিছুটা ভারসাম্য থাকে, যেখানে সশস্ত্র বাহিনীকে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখা যেতে পারে।’
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বর্তমানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে। আর এই মন্ত্রণালয় সাধারণত প্রধানমন্ত্রী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জেনারেল ওয়াকার বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি সাংবিধানিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় এই বিষয়টিতে সম্ভাব্যভাবে সংশোধনের দিকে নজর দিতে পারে।’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে সামরিক বাহিনীকে কখনোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত নয়। একজন সৈনিকের রাজনীতিতে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়।’
কালের আলো/এমএএএমকে