নয়াপল্টনে জনসমুদ্র, রাষ্ট্র এবং রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনে গুরুত্ব তারেক রহমানের
প্রকাশিতঃ 9:37 pm | September 17, 2024
মো.শামসুল আলম খান/রাইসুল ইসলাম খান, কালের আলো:
আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে বিশাল শোডাউন করেছে দলটি। মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সমাবেশ ঘিরে আশপাশের জেলা ও নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী নয়াপল্টনে জড়ো হন। নেতাকর্মীদের ভিড়ে জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে নয়াপল্টন এলাকা। সমাবেশ ঘিরে সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। এছাড়া জ্যেষ্ঠ নেতারাও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ক্ষমতার পরিবর্তন মানে রাষ্ট্র এবং রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমি আগেও বলেছি-ক্ষমতার পরিবর্তন মানে শুধুই রাষ্ট্র ক্ষমতার হাত বদল নয়। তাই প্রতিটি রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মনে রাখা প্রয়োজন যে, রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের আচার-আচরণেও গুণগত পরিবর্তন জরুরি।’
সরেজমিনে নয়াপল্টন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিএনপি নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আসেন দুপুর থেকেই। তাদের অনেকের হাতে ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড ও পোস্টার দেখা গেছে। পল্টন ছাড়াও বিজয়নগর, নাইটিঙ্গেল মোড়, ফকিরাপুল মোড় ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সতর্ক অবস্থায় ছিল এলিট ফোর্স র্যাবের সদস্যরাও। সমাবেশস্থলে আগতদের সিসি ক্যামেরায়ও মনিটরিং করা হয়।
এছাড়া রাজনৈতিক দমন-পীড়নের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে ও আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে সারা দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতেও সমাবেশ ও র্যালি হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন।
উসকানিতে বিভ্রান্ত না হয়ে নেতৃত্ব দানের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত রাখুন
দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘আমার আহ্বান, কোনও প্রলোভন কিংবা উসকানিতে বিভ্রান্ত না হয়ে জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র এবং সমাজের নেতৃত্ব দানের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত রাখুন।’ ‘হাজারো শহীদের রক্তস্নাত এই রাজপথে আজ আপনাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির অর্থ, ছাত্র-জনতার কাক্সিক্ষত বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার এই যাত্রাপথে বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে হয়তো আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আরও কিছু পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে সেই পথ সন্ত্রাস-সংঘর্ষ-প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসার নয়। সেই পথ হবে ধৈর্য-সহনশীলতা এবং সমঝোতার।’
তিনি বলেন, ‘সংস্কার কার্যক্রমের পথ ধরে নির্বাচনি রোডম্যাপে উঠবে দেশ। সুতরাং, আসুন, আমরা সবাই কাজের মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস ভালোবাসা অর্জন করি। জনগণের সঙ্গে থাকি। জনগণকে সঙ্গে রাখি।’ ‘গণঅভ্যুত্থান কিংবা সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানারকম কথা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এটি একটি স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য রীতি। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করবেন, এটিই স্বাভাবিক। এ নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।’
‘একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, ফৌজদারি অপরাধের বিচার যেমন বিচারিক আদালতে হয়, ঠিক তেমনই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কিংবা রাজনৈতিক আচরণের বিচার হয় জনগণের আদালতে।’ বলেন খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমান।
তিনি বলেন, ‘জনগণের কাছে জবাবদিহি-মূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তর্র্বতীসরকার কাজ করছে। তবে মাফিয়াচক্রের প্রধান হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালেও মাফিয়াচক্রের বেনিফিশিয়ারি অপশক্তি প্রশাসনের অভ্যন্তরে থেকে, কিংবা রাজনীতির ছদ্মাবরণে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।’
‘বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকার হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে লাখো কোটি জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফসল। এই সরকারের কোনও কোনও কার্যক্রম সবার কাছে হয়তো সাফল্য হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে। কিন্ত এই সরকারের ব্যর্থতা হবে আমাদের সবার ব্যর্থতা, বাংলাদেশের পক্ষের গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা। এটি আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখতে হবে।’
তারেক রহমানের ভাষ্য মতে, ‘সুতরাং, এই অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। দেশ-বিদেশ থেকে নানারকমের উসকানিতেও জনগণ অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে ব্যর্থ হতে দেবে না। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাতে নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে তাদেরকেও সতর্ক থাকতে হবে। ’
‘বাংলাদেশ কিংবা যেকোনও দেশেই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার অবশ্যই জনগণের সরকার। তাই জনগণ অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। রাখবে। তবে কোনও এক পর্যায়ে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের জবাবদিহিও কিন্তু নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা হয়।’
‘সুতরাং, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম এবং প্রধান টার্গেটও হওয়া জরুরি’, বলেন তারেক রহমান।
এ জন্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত জবাবদিহি-মূলক সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া দরকার। কারণ, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া, সংস্কার কার্যক্রমের প্রক্রিয়ায় জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া— উন্নয়ন ও গণতন্ত্র কিংবা সংস্কার কোনোটিই টেকসই এবং কার্যকর হয় না। একটি অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিটি ভোটারের ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করে ভোটারদের কাঙ্ক্ষিত প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।’
সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত না করলে ফল পাওয়া যাবে না
সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত না করলে ফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতি, সব ক্ষেত্রে সংস্কার একটি ধারাবাহিক চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং, রাষ্ট্র ও রাজনীতির সংস্কারে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার আরও যদি পরিমার্জন ও পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, তাহলে সেটিকেও স্বাগত জানাবো।’
তারেক রহমান আরও বলেন, ‘এমনকি কেউ যদি মনে করেন, উন্নত ও নিরাপদ দেশের জন্য আরও নতুন দলের প্রয়োজন রয়েছে। তাতেও দোষের কিছু নেই।’ ‘কারণ শেষ পর্যন্ত জনগণই সিদ্ধান্ত জানাবেন। এটি তাদেরই চূড়ান্ত বিষয়’- বলে মনে করেন তারেক রহমান। তিনি উল্লেখ করেন, ‘এজন্য বিএনপি বরাবর ভোটের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি মনে করে-দেশের জনশক্তির অর্ধেক নারী এবং তারুণ্যের এই বৃহৎ অংশকে, রাজনৈতিক অংশীদারত্বের বাইরে রেখে একটি বৈষম্যহীন মানবিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। সংবিধান কিংবা প্রবিধানে যাই থাকুক, জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা না গেলে সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করা না গেলে, শেষ পর্যন্ত কোনও সংস্কার কার্যক্রমেরই কার্যকর ফল পাওয়া যাবে না। একমাত্র অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই, রাষ্ট্র- রাজনীতি এবং রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সঙ্গে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশীদারত্ব তৈরি হয়।’
দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশ কিংবা যেকোনও দেশেই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার অবশ্যই জনগণের সরকার। তাই জনগণ অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে, রাখবে। তবে কোনও এক পর্যায়ে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের জবাবদিহিও কিন্তু নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা হয়।’
‘সুতরাং, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠাই অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সব সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম এবং প্রধান টার্গেটও হওয়া জরুরি।’ ‘এ জন্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত জবাবদিহি-মূলক সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া দরকার। কারণ, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া, সংস্কার কার্যক্রমের প্রক্রিয়ায় জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া, উন্নয়ন-গণতন্ত্র কিংবা সংস্কার কোনোটিই টেকসই এবং কার্যকর হয়না-বলেন তারেক।
‘সেই লক্ষ্যে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন জনপ্রশাসনের সংস্কার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘সক্ষম এবং উপযুক্ত’ করে গড়ে তুলতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।’ ‘এবারের গণঅভ্যুথানের চরিত্র অতীতের যেকোনও গণ-অভ্যুথানের চেয়ে ব্যতিক্রম। কেন ব্যতিক্রম? কারণ পলাতক স্বৈরাচারের অবৈধ শাসনকালে সব গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার হারিয়ে জনগণ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বও হারাতে বসেছিল।’
‘তাই, এবারের গণঅভ্যুথানের মধ্য দিয়ে কেবল মানুষের অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা পেয়েছে। দেশ এবং জনগণ এখন গুম খুন অপহরণ আর বিভীষিকাময় ‘আয়নাঘরে’র আতঙ্কমুক্ত, স্বাধীন। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার পর এবার দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা সুরক্ষায় প্রথম কাজ হতে হবে— রাষ্ট্র এবং সমাজে মানুষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার এবং ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন।
তিনি বলেন, ‘দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি ভোটার। এরমধ্যে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ভোটার তালিকায় প্রায় আড়াই কোটি নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে। ভোটার হওয়ার পর তরুণ প্রজন্মের এই আড়াই কোটি ভোটার একটি জাতীয় নির্বাচনেও ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। ভোট দিয়ে তারা তাদের কাক্সিক্ষত জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারেনি। কিংবা তারা নিজেরাও কেউ ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায়নি।’
কালের আলো/বিএস/এমএ