বসন্তে মেতেছে তরুণ-তরুণীরা
প্রকাশিতঃ 2:37 pm | February 13, 2018
কালের আলো:
আমরা সবাই জানি, ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ আমাদের এ বাংলাদেশ। বর্ষ পরিক্রমায় ছয় ঋতুর সঙ্গে আমরা এ বঙ্গের মানুষ যেভাবে পরিচিত হতে পারি সেভাবে বিশ্বের আর কোনো দেশের অধিবাসীরা ঋতুবৈচিত্র্যের এমন নিসর্গ অনুভূতি লাভের সুযোগ পায় না। তাই হয়তো তারা আমাদের মতো করে ঋতুর বন্দনা বা উৎসব পালনের কথা চিন্তাও করে না। যা হোক, আমরা ছয়টি ঋতুর এমন বিচিত্র ব্যাপকতা লাভে সৌভাগ্যবান হলেও ঋতুবিচারে আমাদের সবার কাছে বসন্ত পেয়েছে আলাদা সমীহ। ঋতুরাজের অভিধায় তাই তাকে আমরা ভূষিত করেছি।
আসলে আমরা বাঙালিরা এখন যে ঘটা করে এমন ঋতুভিত্তিক উৎসব উদযাপনের আযোজন করছি তার পেছনে রয়েছে বিশ্বকবির অসামান্য অবদান। কারণ তিনিই এমন জাঁকজকমপূর্ণভাবে এমন উৎসব উদযাপনের প্রচলন করে গেছেন। আমরা সে পথেই হেঁটে হেঁটে আজ এত দূর এসেছি। এজন্যই বসন্তবরণ বলুন আর বাঙালির অন্য কোনো উৎসব উদযাপনের কথাই বলুন, সব ক্ষেত্রেই কবিগুরুর উপস্থিতি ব্যাপক, বিশাল। বসন্তবরণেও তাই তার গান বা কবিতার সাহায্য আমাদের নিতেই হয়।
বসন্তের আগমনে নীরব প্রকৃতি যেন সরব হয়ে ওঠে। গাছে গাছে নবপল্লব, পাখ-পাখালির কলকাকলি, কোকিলের কুহুকুহু শব্দ মনের গহিনে তাই দোলা দিয়ে যায়। ফাগুনে প্রকৃতির এমন পরিবর্তন মানবমনেও অদ্ভুত এক শিহরণ জাগায়। আর তা কবিগুরু তার গানে ব্যক্ত করলেন এভাবে_ ‘আহা আজি এ বসন্তে/এত ফুল ফোটে/এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়…’।
বসন্ত যখন আসে তখন মানবমনে এক অপার্থিব, অব্যক্ত অনুভূতি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে তারুণ্যের হৃদয়ে তা উথাল-পাথাল ঢেউ তোলে। মনে হয় এই বুঝি কী জানি কী হয়! কী যেন কী পেতে চায়! বন্ধুত্ব নাকি প্রেম, ভালোলাগা নাকি ভালোবাসার অনুভূতি, নিজেকে মেলে ধরা নাকি হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি_ এমন বোঝা-না বোঝার দোলাচলে তা সবসময় বয়ে চলে। তবে হৃদয় মেলে দিয়ে, বন্ধ জানালা খুলে দিয়ে বসন্তকে বরণ করে নিতে জানলে তখন সে অনুভূতি হয় দৃশ্যমান, অপার্থিব। জীবন হয়ে ওঠে মধুময়। তাই তারুণ্য যেমন চায় বসন্তের ছোঁয়া তেমনিভাবে বসন্তও আশা করে তারুণ্য তাকে একান্তই নিজের করে নিক। নিজের মতো করে উদযাপন করুক। তারুণ্যের পরশে সে হয়ে উঠুক আরো মোহনীয়, বর্ণিল। এজন্যই বিশ্বকবি তার ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ কবিতায় আমাদের বসন্তের আগমনী ধ্বনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে উদার হৃদয়ে তাকে বরণ করার সুস্পষ্ট তাগাদা দিচ্ছেন এভাবে_ ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/কোরো না বিড়ম্বিত তারে/আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো/আজি ভুলিয়ো আপন পর ভুলিয়ো…’।
বসন্ত শুধু বাংলার প্রকৃতিতেই তার সর্বপ্রভাব বিস্তার করে বিষয়টি এমন নয়। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসন্ত যেভাবেই আসুক না কেন প্রকৃতি ও মানবমনে তার প্রভাব হয়তো একই রকম হয়ে থাকে। নীরবতা বা জড়তা ভেঙে প্রকৃতি সজীব হয়ে ওঠে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়। প্রকৃতিতে এই যে পরিবর্তন আসে তা কি বাঙালি কবিমানসেই শুধু ধরা পড়ে? নাকি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে অনুভূতির এ দুয়ার সবসময়ই এক হয়? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আসুন আমরা একটু দৃষ্টি ঘোরাই পারস্যপানে; উদ্দেশ্য ভিনদেশি কবি ওমর খৈয়ামের কবিতার কিছু চরণ ধার করা। আর দেখে নিই প্রকৃতির এ পরিবর্তনকে তিনি কিভাবে তার কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। এজন্য আসুন নজর দিই তার লেখা কবিতার দিকে। তিনি লিখেছেন_ ‘হাজার নতুন মঞ্জরী এলো শাখাপ্রশাখার কোলে/নীরব কুঞ্জ মুখরিত হ’ল সঙ্গীত কলরোলে/পুরনো পাতারা বিবর্ণ মুখে ঝরে গেল ধরণীতে/নতুন দিনের হাজার বৃন্তে নবপল্লব দোলে…’। এখন নিশ্চয় বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল এভাবে যে, ফাগুন পৃথিবীর যে প্রান্তেই আসুক না কেন তার আগুনঝরা রূপটি সব জায়গায় সবসময় একই রকমের হয়ে প্রতিভাত হয়। আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাই তার স্বভাবজাত ভঙ্গিমায় ফাগুনকে খুনি হিসেবে চিহ্নিত করে বলছেন, ‘এলো খুন মাখা তূণ নিয়ে, খুনেরা ফাগুন’।
ফাগুন যখন আসে তখন কৃষ্ণচূড়া, হিজল, তমাল, পলাশের ডালে ডালে ফুল ফোটে। ফুল ফোটে বনের নাম জানা বা অজানা তরুলতায়। কচি পাতার ফাঁকে ফুলের এমন সমারোহ সত্যিই দারুণ ব্যাপার। চোখ জুড়িয়ে যায়। তবুও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ফুল ফোটার সঙ্গে বসন্তের সম্পর্ক নিরূপণ করতে রাজি নন। তিনি তাই ব্যাকুল হয়ে ফুল ফোটার তোয়াক্কা না করে অনায়াসেই বলতে পেরেছেন_ ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক/আজ বসন্ত’।
আমাদের কাছে বসন্তের যেমন সাংস্কৃতিক গুরুত্ব আছে তেমনি এর রাজনৈতিক দিকটাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ বসন্তেই আমাদের পূর্বসূরি তরুণরা তাদের রক্ত দিয়ে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। তবুও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তার আপন মহিমায়। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের সেই রক্তসিঁড়ি বেয়েই পরে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তাই আমাদের কাছে ফাগুন আসে আনন্দ ও বেদনার মিশ্র এক অনুভূতি নিয়ে। এজন্য কৃষ্ণচূড়ার লাল রং যেন প্রতীকী রক্তের রং হয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে। আমরা আবেগাক্রান্ত হই।
বর্তমানে আমাদের স্বদেশভূমি এক অস্থির সময় পার করছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক নেতাদের অদূরদর্শিতা আর ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতির কাছে আমরা রীতিমত অসহায়। অগি্নবোমার তা-বে গণতন্ত্রের প্রাণ যে আজ হুমকির মুখে। তাদের শরীরে পুড়ে যাওয়ার দগদগে ক্ষতচিহ্ন। মাতৃভূমির এমন অধঃপতন দেখতে আর কাহাতক ভালো লাগে? জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী আমাদের উঠতি তরুণ-তরুণীরা আজ হরতালভারে জর্জরিত। কবে তাদের এ পরীক্ষা শেষ হবে তা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে আমরা অন্ধকারপানে ধেয়ে চলছি অবিরাম।
রাজনীতির এহেন দৈন্যদশার মাঝে এবারের ফাগুন এসেছে। চারদিকের এমন হতাশাজনক পরিস্থিতির মাঝে সময় পার করা তারুণ্যের হতাশা দূর করার উপলক্ষ হয়েই তা এসেছে। এজন্য আমরা আশা করতেই পারি বরাবরের মতো ফাগুনের প্রথম দিনে ঢাকার রাজপথ বাসন্তী রঙে রঙিন হয়ে উঠবে। তারুণ্যের উন্মাদনা ও ব্যাপক অংশগ্রহণে সে রূপ আরো পূর্ণতা পাক সে প্রত্যাশা রেখে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে শান্তিময় বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে কবিগুরুর সুরে সুর মিলিয়ে আসুন গেয়ে উঠি_ ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন ঘটাতে’। বিভেদ নয়, ঐক্য; সংঘাত নয়, শান্তি_ এ প্রত্যাশা নিয়ে আসুন উদযাপন করি এবারের ফাগুন।