জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০০ গাছ কাটার প্রস্তুতি
প্রকাশিতঃ 7:17 pm | April 27, 2024
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
গরমের তীব্রতা থেকে বাঁচতে দেশব্যাপী বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে চলছে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। গরম থেকে গাছই যখন রক্ষা করে, ঠিক এমন সময় ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় ৪০০ গাছ কাটার প্রস্তুতি নিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) প্রশাসন।
সারা বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অংশ হিসেবে বাদ নেই আমরাও। বাংলাদেশে মনুষ্যসৃষ্ট কারণ যেমন: গাছপালা কেটে ফেলা, বন উজাড় করা, গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলাশয় ভরাটের কারণে দিন দিন তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। কিন্তু এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের এমন সিদ্ধান্ত অবাক করার মতো।
সরেজমিনে দেখা যায়, চারুকলা অনুষদের ভবন, গাণিতিক ও পদার্থবিদ্যা বিষয়ক অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন ও জীববিজ্ঞান অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন নির্মাণের জন্য টিনের ঘেরাও দিয়েছে প্রশাসন।
দরপত্র থেকে জানা যায়, জীববিজ্ঞান অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের জন্য ৪৮ কোটি, গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের জন্য ৫৮ কোটি ও চারুকলা অনুষদের জন্য ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। জীববিজ্ঞান অনুষদ ও গাণিতিক ও পদার্থবিজ্ঞান অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নির্মিত হচ্ছে আর চারুকলা অনুষদ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে।
জীববিজ্ঞান অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের জন্য ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাগারের বিপরীতে এবং গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের জন্য পদার্থবিজ্ঞান ভবনের পাশের জলাশয়ের জায়গা বরাদ্দ করেছে প্রশাসন।
অন্যদিকে চারুকলা অনুষদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-বেরুনি হলের বর্ধিতাংশের জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই জায়গাগুলোয় ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় ৪০০ গাছ কাটার বন্দোবস্ত করেছে। পাশাপাশি চারুকলা ভবনের জন্য বরাদ্দ করা জায়গা অতিথি পাখির ‘ফ্লাইং জোন’ হিসেবে পরিচিত।
দেশের গরমের এই পরিস্থিতিতে কোনও ধরনের মহাপরিকল্পনা ছাড়া এতগুলো গাছ কাটার সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনরা।
অপরিকল্পিত উন্নয়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসা ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের একাংশের সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, ‘তারা মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া কাজ শুরু করতে চায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই। কারণ তারা লুকোচুরি করে কাজ শুরু করতে পারলে তাদের কোনও স্টেকহোল্ডারদের কাছেই জবাবদিহি করতে হয় না। লেকচার থিয়েটার হলে ৬২টি ক্লাসরুমে প্রতি ঘণ্টায় ৬ হাজার ২০০ জন শিক্ষার্থী ক্লাস করতে পারবে। তারপরও তিনটি অনুষদের এক্সটেনশন বিল্ডিং তাদের দরকার।
তিনি আরও বলেন, যেখানে দ্বিতীয় রেজিস্ট্রার ভবনটাই পূর্ণাঙ্গ করা যায় মাত্র ৪০ কোটি টাকায়, সেখানে কিছু তোয়াক্কা না করে প্রশাসন তৃতীয় প্রশাসনিক ভবন করতে চায়। কারণ অর্থ অপচয় করে পকেট ভারী করা যায়। ফলে প্রকল্প অফিস হয়ে গেছে জাহাঙ্গীরনগরে দুর্নীতির আঁতুড়ঘর। টাকা আসছে টাকা খরচ করতে হবে, ভাগবাঁটোয়ারা করতে হবে—তারা আছে এই নীতিতে। যে কারণে মাস্টারপ্ল্যানের তোয়াক্কা না করে এ রকম ধ্বংসাত্মক ক্যাম্পাস তৈরি করছে। দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান করে যদি এই কাজগুলো হতো, তাহলে আমাদের তাতে কোনও বাধা থাকতো না। এই পরিস্থিতি বড় কোনও আন্দোলনের দিকেই আমাদের নিয়ে যাচ্ছে।’
নতুন ভবনের প্রয়োজনীয়তা
জানা যায়, অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হচ্ছে ১০ তলাবিশিষ্ট লেকচার থিয়েটার হল কাম এক্সামিনেশন হল।
নির্মিতব্য এই লেকচার থিয়েটারে ৬২টি সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষ থাকবে, যাতে একসঙ্গে ১০০ জন শিক্ষার্থী বসতে পারবেন। প্রতিটি ক্লাসরুমে ওয়াল র্যাক থাকবে, যেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য ল্যাপটপ ও অন্যান্য পাঠ-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা যাবে। আরও থাকবে ১০টি ল্যাব, যা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও অন্য শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করতে পারবে। নির্মাণাধীন লেকচার থিয়েটার দুটি চালু হলে ক্লাস রুম সংকটের পাশাপাশি ল্যাব সংকট ও দূর হবে। কেবল বরাদ্দ থাকায় নতুন ভবন নির্মাণ করাকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।
অপরিকল্পিত উন্নয়নে ভোগান্তি
এদিকে অপরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। অপরিকল্পিতভাবে শহীদ রফিক জব্বার হলের পাশে ছেলেদের নতুন তিনটি হল নির্মাণ করা হয়েছে। শব্দদূষণ, নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে শেখ রাসেল হলের ও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হলের রাস্তায় দেয়াল তুলে দিয়েছেন শহীদ রফিক জব্বার হলের শিক্ষার্থীরা। এর সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে গত মার্চে সংঘর্ষে জড়ান তিন হলের শিক্ষার্থীরা। সংঘর্ষে দুই হলের সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ টাকা।
ছাত্রীদের নতুন হল করা হয়েছে ঢাকা আরিচা মহাসড়কের ১০০ ফুটের মধ্যে। গাড়ির শব্দে মাথাব্যথা, রাতে ঘুম না হওয়া, পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে না পারাসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের।
অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনও। ভবনটি হল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের রাস্তার পাশে হওয়ায় গাড়ির শব্দে ক্লাস করতে সমস্যা হতো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। তাই সেই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর আগে মেয়েদের মাঠ তৈরির কথা বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের টারজান পয়েন্টে গাছ কাটা হয়। তবে কিছুদিন পর পরিকল্পনা পাল্টে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ছাত্রীদের হল থেকে কাছে হওয়ায় ছাত্রদের নিরাপত্তা বিবেচনায় প্রশাসনিক ভবন থেকে যাতে ছাত্রী হল দৃশ্যমান না হয়, এ জন্য সেখানে পুনরায় গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গাছপালা থাকার সুফল
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সসিং অ্যান্ড জিআইএসের গবেষণায় দেখা গেছে, গাছপালা থাকলে তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি কম থাকে। ঢাকার সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে।
গবেষক দলের নেতৃত্বে থাকা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শেখ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, গাছপালার আচ্ছাদন থাকার ফলে সূর্যরশ্মি সরাসরি মাটিতে পৌঁছাতে পারে না। এটি সে এলাকায় মাইক্রো ক্লাইমেট ভালো রাখে। গাছপালা থাকলে মাটিতে অনেক লতাগুল্ম জন্মে। সব মিলিয়ে স্থানীয় তাপমাত্রা কমে যায়। যে স্থানে গাছ নেই, সেখানে সূর্যের তাপমাত্রা মাটিতে এসে সরাসরি পড়তে থাকে। এতে ক্যাপিলারি ফ্লোর কারণে মাটিতে ভূগর্ভস্থিত পানির স্তর নেমে যেতে থাকে। গাছ কম থাকলে কয়েক দিনের টানা বেশি তাপমাত্রা পরিবেশে যুক্ত হতে থাকে।
তবে ‘একটি সবুজ টেকসই ক্যাম্পাস বিনির্মাণে চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে দেখা যায়, গত ৩৫ বছরে (১৯৮৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছপালা কমেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ।
এভাবে গাছপালা কমতে থাকলে জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি প্রাকৃতিক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের দাবি, উন্নয়নের জন্য গাছ কাটা প্রয়োজন হলেও তা যেন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের মাধ্যমে হয়।
কালের আলো/বিএএ/এমএইচ