উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এমপিদের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে হুঁশিয়ারি করলেন ইসি আনিছুর

প্রকাশিতঃ 6:37 pm | April 24, 2024

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান। এক্ষেত্রে তিনি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ১৫ মিনিট আগে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর প্রার্থিতা বাতিলের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

বুধবার (২৪ এপ্রিল) নগরীর পিটিআই মিলনায়তনে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলার নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে তিনি একথা বলেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের এবারের নির্দেশনা হচ্ছে, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য গত সাত জানুয়ারির নির্বাচনে আপনারা যা যা করেছিলেন, তার সবগুলোই বহাল থাকবে। হয়তো কেউ কেউ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কথা বলতে পারেন। এখন যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাদের অনেকে কিন্তু সাত জানুয়ারির সময়ও নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। আবার তাদের অনেকে প্রার্থীও ছিলেন। সে কারণে তখন তাদের অতটা প্রভাব ছিল না। যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন, তারাও নিজ দলেরই ছিলেন, তারাও কম শক্তিশালী ছিলেন না। সে কারণেই হয়তো চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স হয়ে গিয়েছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু উপজেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এখন বিদ্যমান এমপি সাহেব, মন্ত্রী মহোদয়রা আছেন, তাদের কিছু প্রভাব থাকতে পারে কিংবা কিছুটা ভিন্নতা আসতে পারে। এমপি সাহেবরা যাতে হস্তক্ষেপ না করে, যাতে অবৈধ প্রভাব না খাটায়, বিষয়টি কমিশনের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। মাননীয় স্পিকারকেও বলা হয়েছে, যেন এমপি সাহেবদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। মানুষ কিন্তু ভোট দিতে চায়, মানুষ ক্ষমতা কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখতে চায় না।’

যেখানেই অনিয়ম, কারচুপি কিংবা অন্যায় কার্যক্রম হবে এবং নিয়ন্ত্রণ বর্হিভূত পরিস্থিতি তৈরি হলে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য প্রিজাইডিং অফিসারদের নির্দেশনা দেন ইসি।

এ পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনার সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কখনোই প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার রেকর্ড ছিল না। এবার মানে গত সাত জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামে কিন্তু ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ১৫ মিনিট আগে প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। বাতিল করার মতো উপাদান ছিল। সপ্তাহখানেক আগে থেকেই তার অ্যাক্টিভিটিজ আমরা ট্র্যাক করছিলাম। যখন তাকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, যখন থানায় ঢুকে গিয়ে ওসিকে মারধর করছেন, সার্কেল অ্যাডিশনাল এসপি যখন উনাকে নিবৃত্ত করতে পারছেন না, এরপর তো বসে থাকা যায় না। তাহলে তো আমাদের আর অস্তিত্ব থাকে না। তখন আমরা চরম সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম।’

ইসি আনিছুর বলেন, ‘তারপর উনি কি করেছেন সেটা পরের বিষয়। আইন-আদালত আছে। কিন্তু কাজ তো হয়েছে। আমরা কিন্তু ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচন চলাকালীনও এমন সিদ্ধান্ত নিতে কোনো কুণ্ঠাবোধ করব না। এ কমিশনই কিন্তু গাইবান্ধায় ব্যাপক অনিয়ম-কারচুপির কারণে উপনির্বাচন বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন দিয়েছিল।’

নির্বাচন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আইন থাকলে হবে না, আইনের প্রয়োগ করতে হবে। আপনারা আইনের পক্ষে আপনাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। সরকার প্রধানও চান না যে, ভোটটা খারাপ হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন, ভোটটা সুন্দর হোক। আপনাদের কাছে আকুল আবেদন, ভোট সুন্দরভাবে করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না।’

উল্লেখ্য, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন। ওই আসন থেকে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের টিকিটে। তৃতীয় দফায় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনি ডামাডোল শুরুর পর থেকে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্ম দেন তিনি। সর্বশেষ ভোটগ্রহণের সময় চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানায় ঢুকে ওসিসহ পুলিশ সদস্যদের ওপর আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর চড়াও হওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর নির্বাচন কমিশন ভোট শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে তার প্রার্থিতা বাতিলের ঘোষণা দেন। ফলে ওই চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান।

এদিকে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রভাব মোকাবিলায় আইন সংশোধনের চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানান।

সভায় তিনি বলেন, ‘এমপি সাহেব শুধু ওই এলাকার জনপ্রতিনিধি নন, তিনি ওই এলাকার ভোটারও হতে পারেন। তো, ভোটার হলে আইনের বিধান হচ্ছে, ভোট দিতে হবে উনাকে ওখানে। আমরা হয়তো একটা সিদ্ধান্তে আসব। জানি না সরকার এটাতে একমত হবে কি না। সব নির্বাচনি বিধিমালায় দুই বছরের মধ্যে সংশোধন আনা হবে। এর মাধ্যমে এমপি সাহেবদের রেস্ট্রিক্ট করা যায় কি না। তারা আসবেন, ভোটার হলে ভোট দিয়ে চলে যাবেন। বিকল্প হচ্ছে, এমপি সাহেবদের ভোটটা আমরা ওখানে (ইসি) নেব, রিটার্নিং অফিসারের মাধ্যমে সেটা পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এগুলো একেবারেই চিন্তাভাবনা, যাতে এমপি সাহেবদের বিরত রাখা যায়।’

তবে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের ভোট থেকে বিরত থাকার ঘোষণাকে আইনের পরিপন্থী বলে উল্লেখ করে আনিছুর বলেন, ‘একটা দল, যারা এখন শাসক দল হিসেবে পরিচিত, তাদের দলীয় প্রধান, যিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তিনিও বলেছেন এবং শাসক দলের সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন এমপি-মন্ত্রীদের প্রভাবের বিষয়ে কিংবা তাদের আত্মীয়স্বজনের প্রার্থিতার বিষয়ে বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। যদিও এটা আইনের মধ্যে পড়ে না, এটা আইনের পরিপন্থী, এটা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমরা কিন্তু এটা বলিনি। আমরা এটা বলতে পারি না। নির্বাচন করার অধিকার আছে প্রত্যেকেরই। যিনি ১৮ বছর বা তদুর্ধ্ব, যিনি ভোটার হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেরই নির্বাচন করার অধিকার আছে।’

নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান আরও জানান, সংসদ নির্বাচন একইদিনে সম্পন্ন হলেও সরকারের ব্যয় সংকোচনের অনুরোধ মাথায় রেখে চার ধাপে উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৮ মে ১৫০টি উপজেলায় প্রথম পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাকি জেলাগুলোতে ২১ মে, ২৯ মে ও ৫ জুন নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। তবে বান্দরবান জেলার তিনটি উপজেলায় নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়েছে। দুর্গম, পাহাড়ী, দ্বীপ ও চরাঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ভোটের আগের দিন ব্যালট পৌঁছানো হবে। বাকি জেলাগুলোতে ভোটের দিন সকাল ৮টার আগে ব্যালট পেপার পৌঁছে দেয়া হবে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলামের সভাপতিত্বে সভায় সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নুরে আলম মিনা, বিজিবির আঞ্চলিক কমান্ডার আজিজুর রহমান, জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ইউনুচ আলী এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কালের আলো/ডিএস/এমএম