যুগোপযোগী সশস্ত্র বাহিনীর রূপান্তরের রূপকার প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিতঃ 11:00 pm | November 20, 2023

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর :

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) বিশাল জনসমুদ্রে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে ঘোষণা দেন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের। সুনির্বাচিত ও সুচিন্তিত প্রতিটি শব্দে ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরেন। মহাকাব্যের অমর পঙক্তিমালায় সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়- তারপর থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের। বঙ্গবন্ধুর স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতার সেই বীজমন্ত্র। অত:পর মন্ত্রমুগ্ধ বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির যুদ্ধে; ঘরে ঘরে গড়ে তোলে অপ্রতিরোধ্য দুর্গ। দ্বার খুলে যায় স্বাধীনতার।

মূলত ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দিকনির্দেশনায় প্রবল প্রদীপ্ত আন্দোলনের জোয়ারে সেই সময় দেশপ্রেমী সশস্ত্র বাহিনীর হৃদয়েও আঁকা হয় একটি লাল-সবুজ পতাকা। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ছবি। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ইতিহাসের মহানায়কের ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায়। স্বাধীনতার চিরভাস্বর সূর্য উদয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালেই ২১ নভেম্বর সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। জ্বলে উঠে পরাধীনতার বিরুদ্ধে। দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর অকুতোভয় সদস্যরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যৌথভাবে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণের সূচনা করেন। শুধু কী তাই? সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সৈনিকরা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে হাজারো মুক্তিযোদ্ধাকে। আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় পাকিরা। ৯ মাসের গণযুদ্ধের পর এসেছিল বিজয়। উড়েছিল বিজয় নিশান। অভ্যুদয় ঘটেছিল বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের।

বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয় ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান। সেই থেকে ২১ নভেম্বর, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ গৌরবময় দিন। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অসামান্য আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাঁথা বাঙালি জাতি চিরদিন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণ করে। মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনায় প্রতিবছর ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে। এবারও যথাযোগ্য মর্যাদা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আজ দিবসটি উদযাপন করা হবে। বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করা হবে স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী সশস্ত্র বাহিনীর বীর সন্তানদের।

জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সেনারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল যশোর সেনানিবাস, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল জয়দেবপুর, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল সৈয়দপুর, চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল কুমিল্লা ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল চট্টগ্রাম বিদ্রোহ করে এবং সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। এই পর্যায়ে সুসংহত ও সমন্বিত যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে গঠন করা হয় এস ফোর্স, জেড ফোর্স ও কে ফোর্স নামে সেনাবাহিনীর নিয়মিত তিনটি ব্রিগেড। যুদ্ধে গোলন্দাজ সহায়তা প্রদানের জন্য মুক্তিযোদ্ধার সময় গঠিত হয় মুজিব ব্যাটারি, রওশন আরা ব্যাটারি ও স্বতন্ত্র রকেট ব্যাটারি। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারাদেশজুড়ে কিলো ফ্লাইট ও অপারেশন জ্যাকপটের মতো অপারেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী দেশের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মহান বিজয় লাভ করে।

ইতিহাসের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই অমিয় বাণী- ‘আজ লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। সেই জন্যই আজ বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি স্থাপিত হয়েছে। আমি স্মরণ করি সেই সমস্ত শহীদ ভাইদের যারা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে। আত্নাহুতি দিয়েছে। আজ সত্যিই গর্বে আমার বুক ভরে যায়। মনে রেখো জনগণ কারা? তোমার বাপ তোমার ভাই। তোমরা তাদের মালিক নও। তোমরা তাদের সেবক। তাদের শ্রদ্ধা করতে শিখো। তাদের ভালোবাসতে শিখো।’ জাতির পিতার এ উপদেশ হৃদয়ে ধারণ করে আসছে সশস্ত্র বাহিনীর সূর্য সন্তানেরা। দেশের যেকোনো দুর্যোগে আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছে সশস্ত্র বাহিনী।

ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালেই একটি প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করেন। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞাময় দূরদর্শী নেতৃত্বে প্রণয়ন করেছেন ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তিনি। তাঁরই দিকনির্দেশনায় সশস্ত্র বাহিনী আজ পরিণত হয়েছে শক্তিশালী ও পেশাদার বাহিনীতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি জাতির যেকোন সঙ্কটে সশস্ত্র বাহিনীর সকল সদস্য সর্বদা প্রস্তুত।

সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে বঙ্গবন্ধুকন্যার অবদান
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিজের পরিবারের সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধনের কথা বারবার নিজের কন্ঠে তুলে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দুই ভাই শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং দু’জনই সেনাসদস্য ছিলেন। ছোট ভাই শেখ রাসেলের ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

ফলত বাঙালি জাতির গর্ব ও আস্থার প্রতীক সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে নিরলসভাবেই কাজ করে চলেছেন সরকারপ্রধান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের গত ১৫ বছরে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। প্রায় সময়েই নিজের কন্ঠে তিনি উচ্চারণ করেছেন পিতা মুজিবের সেই অমর বাণী-‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হবে জনগণের বাহিনী তথা পিপলস আর্মি।’ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সীমিত সম্পদ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালেই গড়ে তোলেন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, কম্বাইন্ড আর্মড স্কুল এবং সেনাবাহিনীর প্রতিটি কোরের জন্য স্বতন্ত্র ট্রেনিং স্কুল।

‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ এর আলোকে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে অত্যাধুনিক সাজোয়া যান ও গোলন্দাজ কোরে মাঝারি ও দূরপাল্লার এমএলআরএস রেজিমেন্ট। আকাশ বিধ্বংসী ভি-শোরাড ও সর্বাধুনিক অরলিকন গান ও মিসাইল সিস্টেম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আকাশ প্রতিরক্ষায় সূচিত হয়েছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। অত্যাধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও সিগন্যাল সরঞ্জামাদি ছাড়াও বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, হেলিকপ্টার, ইউএসবি, মডার্ন ইনফ্রেন্টি গেজেট, ট্যাংক এমবিটি ২০০০, এমএলআরএস, এপিসি, এসপি গান, এফএম ৯০ মিসাইলসহ আরও নানাববিধ অস্ত্র সরঞ্জামাদি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সংযুক্ত হয়েছে।

সকল অস্ত্র সরঞ্জামাদির জন্য প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো সম্প্রসারণ ও বিপুল সংখ্যক নতুন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও আরও নানাবিধ অস্ত্র সরঞ্জামাদি ও ভৌত কাঠামো সংযোজন ও সম্প্রসারণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বর্তমান সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবকাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি আভিযানিক সক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়কালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৭, ১০ ও ১৭ পদাতিক ডিভিশন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নিরাপত্তা ও তদারকির জন্য একটা কম্পোজিড ব্রিগেড, ২টি ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড, একটি এয়ার ডিফেন্স আর্টিলারি ব্রিগেড এবং প্যারা কমান্ডো ব্রিগেডের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বীর বাঙালির রক্তস্নাত স্বাধীনতার মূল্যবোধে জাগ্রত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে গড়া নৌবাহিনী তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ একটি পেশাদার শক্তিশালী ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনীতে পরিণত হয়েছে। নৌবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে দুটি আধুনিক সাবমেরিন, বানৌজা নবযাত্রা ও জয়যাত্রা। আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ জাহাজ, ফ্রিগেট, কর্ভেট, নার্জ প্যাট্রল ক্রাফট, পেট্রোল ক্রাফট ও বিশেষ নৌ কমান্ডো দল সোয়াডস। এছাড়া সমুদ্রে জরুরি উদ্ধার ও টহল পরিচালনার জন্য নৌ বহরে অন্তভূর্ক্ত হয়েছে মেরিটাইম প্যাট্রল এয়ারক্রাফট ও হেলিকপ্টার সুবিধা সম্বলিত নেভাল এভিয়েশন। আধুনিক যুদ্ধ জাহাজ ওমর ফারুক, আবু উবায়দা, প্রত্যাশা, দর্শক ও তল্লাশি সংযোজনের মাধ্যমে নৌ বহরের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি চলমান রয়েছে আধুনিক সার্ভিলেন্স ইকুইপমেন্ট সংযোজন, কমব্যাট ইনফরমেশন সেন্টার সিস্টেমসমূহের আধুনিকায়নের কার্যক্রম। জাহাজসমূহে স্থাপন করা হয়েছে থ্রিডি সার্চ ও সার্ভিলেন্স রাডার।

মহান জাতির পিতার দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তে ১৯৭৩ সালে সেই সময়ের অত্যাধুনিক সুপারসনিক মিগ-২১ যুদ্ধবিমানসহ হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমান, এয়ার ডিফেন্স রাডার ইত্যাদি বিমান বাহিনীতে সংযোজন করা হয় এবং এরই মাধ্যমে এই দেশে একটি আধুনিক বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবাহিনীতে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান, পরিবহন বিমান, হেলিকপ্টার, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আকাশ প্রতিরক্ষা রাডার, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র সংযোজন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই প্রত্যাশা করেন বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি উন্নয়নমূলক কাজে অবদান রেখে দেশের গৌরব সমুন্নত রাখবে। দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে সদা প্রস্তুত থাকবে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।

বঙ্গবন্ধুর সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে দৃঢ় ও অবিচল সশস্ত্র বাহিনী
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বঙ্গবন্ধুর সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে দৃঢ় ও অবিচল। জাতির পিতার সেই অমিয় বাণী- ‘বিশ্বের এই এলাকায় এবং সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠা ও অক্ষুন্নতার প্রতি প্রচেষ্টায় আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে’- বিশ্বের শান্তি রক্ষায় ইতিহাসের মহানায়কের এই চিন্তাধারাই অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ১২২টি দেশের মধ্যে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হবার বিরল গৌরব অর্জন করেছে। গত তিন দশকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের ৪০টি দেশের ৫৫টি শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশে সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় ৬ হাজার ৯২৪ শান্তিরক্ষী নিয়োজিত আছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য তথা বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের এই প্রশংসনীয় দক্ষতা ও সক্ষমতা অর্জনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নির্দেশনা ও সুদৃঢ় নেতৃত্বকে বরাবরই উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

গত বছর আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবসের বাণীতে তিনি বলেন, ‘মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশিত পথেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অদ্যাবধি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং আজ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অগ্রদূত হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।’

চলতি বছরের সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে দেওয়া এক বাণীতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান বলেছেন, ‘আমি আশা করি, সশস্ত্র বাহিনী দিবসে নৌসদস্যগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে এবং জাতির পিতার প্রদর্শিত পথে পরিচালিত হয়ে সুউচ্চ পেশাদারিত্বের মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে নৌবাহিনীর উজ্জ্বল ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখতে সদা সচেষ্ট থাকবে।’

গত বছর আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবসের বাণীতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান বলেন, ‘জাতিসংঘের চলমান শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সদস্যগণ স্টাফ অফিসার এবং মিলিটারি অবজারভার হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। পেশাগত অবদান ছাড়াও সিভিল-মিলিটারি কো-অপারেশন কার্যক্রমের আওতায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর শান্তিরক্ষীগণ সংঘাতময় অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, দুস্থ জনগণকে কারিগরি দক্ষতা অর্জনে সহায়তা এবং চিকিৎসা ও সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে শুধুমাত্র বিভিন্ন দেশের জনগণের আস্থাই অর্জন করেন নি, মানবসেবায় বাঙালি জাতির আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বব্যাপী।’

সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত বছর আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবসের বাণীতে বলেছিলেন, ‘শান্তির অনন্য দূত বাংলাদেশ। বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের নাম আজ সর্বজনবিদিত। জাতিসংঘের মহাসচিব এবং বিশ্ব বরেণ্য নেতৃবৃন্দের বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের পেশাদারিত্ব, সাহসিকতা এবং আন্তরিকতার ভূয়সী প্রশংসা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌছে দিয়েছে।’

জানা যায়, শান্তিরক্ষা মিশনে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি মোকাবেলায় যোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েনের আগে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং বা বিপসট আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শান্তিরক্ষী প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েনের পূর্বে সশস্ত্র বাহিনীর শান্তিরক্ষীরা প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে বাস্তবধর্মী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী শান্তিরক্ষীদের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জামাদিতে সজ্জিত করে মিশন এলাকায় মোতায়েন করা হয়। অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদিতে সজ্জিত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর শান্তরক্ষীদের দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আভিযানিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর শান্তিরক্ষীরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কন্টিনজেন্টসমূহ যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরিচালনা করছে বহু সফল অভিযান। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় যুদ্ধ বিরতি পর্যবেক্ষণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশি চৌকস কমান্ডোদের দিয়ে গড়া দ্রুত মোতায়নযোগ্য স্পেশাল ফোর্স কন্টিনজেন্টসমূহ জটিলতর পরিস্থিতিতে পরিচালনা করছে বিশেষ অভিযান। জাতিসংঘের অধীনস্থ মেরিটাইম টাস্কফোর্সের ভূমধ্যসাগরে লেবানিজ জলসীমায় ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী যুদ্ধ জাহাজ লেবাননের ভূখণ্ডে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ অনুপ্রবেশ প্রতিহত করছে। পাশাপাশি দক্ষিণ সুদানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি মেরিন ইউনিট সফলভাবে অপারেশন লাইফ লাইন অভিযান পরিচালনা করছে। একটি সি-১৩০ এবং ৯টি এমআই সিরিজের হেলিকপ্টার সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কন্টিনজেন্টসমূহ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীদের নিষ্ক্রিয়করণ অভিযানে নিয়োজিত সামরিক ও অসামরিক ব্যক্তিদের নিরাপদ পরিবহন ও উদ্ধার এবং দুর্গমস্থানে প্রয়োজনীয় রসদ সামগ্রী দ্রুত পরিবহনে সহায়তা করছে।

এছাড়াও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল, এয়ার ফিল্ড সাপোর্ট প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স’র সদস্যরা মিশন এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিমান চলাচল নিশ্চিত করছে। আভিযানিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর শান্তিরক্ষীরা তাদের মানবিক আচরণের মাধ্যমে মিশন এলাকায় নিরীহ জনসাধারণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত মিশন এলাকায় আর্থ সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর শান্তিরক্ষীরা নিজস্ব উদ্যোগে ম্যান্ডেটের অতিরিক্ত হিসেবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যালয় নির্মাণ, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, কৃষি সম্প্রসারণসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে।

মিশন এলাকার জনসাধারণের কাছে তাই বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। কালো আমেরিকানদের কালো উপনিবেশ লাইবেরিয়া নামের দেশটিতে গৃহযুদ্ধের পর সব সড়ক পুনর্নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের হাতে। লাইবেরিয়ায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সম্মানে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ স্কয়ার। সিয়েরা লিওন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা ভাষা স্বীকৃত হয়েছে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। এই পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ১৪৪ জন সদস্য শহীদ হয়েছেন এবং আহত হয়েছে ২৪৭ জন।

সশস্ত্র বাহিনী আজ দেশ ও জনগণের আস্থার প্রতীক
দেশের অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফুটাতেই স্বাধীনতার পর থেকে ঘটে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী সকল দুর্যোগে আর্ত মানবতার সেবায় সবার আগে পাশে ছিল সশস্ত্র বাহিনী। মানুষের জীবন বাঁচাতে তাঁরা ছুটে গিয়েছে অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধ্বসসহ সকল জাতীয় দুর্যোগে। অদৃশ্য শত্রু করোনা মহামারী মোকাবেলায় বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শুধু দেশেই নয় বন্ধুপ্রতিম দেশসমূহের সংগঠিত দুর্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে তাঁরা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। মানবতা, দেশপ্রেম ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনী আজ হয়ে উঠেছে দেশ ও জনগণের আস্থার প্রতীক।

কালের আলো/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email