বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার ঘ্রাণ জড়ানো নয়নাভিরাম স্থাপনা ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’
প্রকাশিতঃ 7:59 pm | November 10, 2023
কালের আলো রিপোর্ট:
তিনি ছিলেন বাঙালির মুক্তিদাতা। বিজয়ী বীর কিংবা ইতিহাসের মহানায়ক। ছিলেন বাঙালির স্বপ্নপুরুষ। জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান স্বাধীনতার এই রূপকার ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬ দফা আন্দোলনসহ প্রতিটি লড়াই সংগ্রামে পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা। বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশকে। রক্তনদী পেরিয়ে জন্ম নেওয়া শৃঙ্খলমুক্ত, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছরের পূর্তির দিনে ২০২১ সালে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারের বর্ণিল কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত হয় ধন্য সেই পুরুষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশালাকৃতির নান্দনিক ভাস্কর্য।
একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টার ভাস্কর্যটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি পছন্দ হয় বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ-সঙ্কটের সঙ্গী ছোট বোন শেখ রেহানারও। তিনিই প্রথম বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রস্তাব করেন ভাস্কর্যটি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের। এরপর প্রধানমন্ত্রী পুরো বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিনের সঙ্গে আলোচনা করেন।
তাঁরা বেশ কয়েকটি স্থান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বিজয় সরণিতে ভাস্কর্যটি স্থাপনে সেনাপ্রধানকে নির্দেশনা প্রদান করেন। প্রায় ৫ মাসে সেনাবাহিনী প্রধানের পরিকল্পনা, দিকনির্দেশনা, অক্লান্ত ও নিরলস পরিশ্রমে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাস্কর্যটি রাজধানীর বিজয় সরণির ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণে’ স্থাপিত হয়েছে। শুক্রবার (১০ নভেম্বর) সকাল ১০টায় বিজয় সরণিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য সম্বলিত মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিজের বক্তব্যে পুরো ভাস্কর্যের আদ্যোপান্ত ওঠে আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জবানীতে। তিনি বলেন, ‘আমার ছোট বোন শেখ রেহানা প্রথম বললো ভাস্কর্যটি খুব সুন্দর হয়েছে। এটিকে ভালো জায়গায় রাখা যায় কীনা? তখন আমি মাননীয় সেনাপ্রধানকে বললাম এটিকে কোথায় সুন্দরভাবে স্থাপন করা যায়? আমরা আলোচনা করে কয়েকটি স্থান নির্বাচন করার পর বিজয় সরণির এই স্থানটিকে চূড়ান্ত করা হয়েছে। কারণ এই স্থান দিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ব্যক্তিরা যাতায়াত করে থাকেন। এছাড়া, স্থানটির পাশেই রয়েছে জাতীয় সংসদসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।’ প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর্যটি স্থাপনার সঙ্গে জড়িত এবং উপস্থিত সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
কী আছে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণে?
‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণে’ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান তুলে ধরা হয়েছে। প্রাচীরের ম্যুরালে খোদাই করে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান এবং ভাষা আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’ স্বাধীনতাকামী জনগণের হৃদস্পন্দন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা। স্থাপত্যটির সাতটি প্রাচীর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের আলোকিত ৭টি আন্দোলন তথা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি। এছাড়াও সাতটি প্রাচীর দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে নির্দেশ করে। পাশাপাশি ক্রম উর্ধ্বগামী ৭টি প্রাচীর জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার প্রত্যয়ে তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নকে নির্দেশ করে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সমৃদ্ধ ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’ সকলকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে এবং নতুন প্রজন্মকে বাঙালির সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন করবে।
এটি শুধু একটি ভাস্কর্য নয়, এটি একটি ইতিহাস
‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’ উদ্বোধন করার পর নিজের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই ভাস্কর্যের গায়ে লেখা আছে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তাই এটি শুধু একটি ভাস্কর্য নয়, এটি একটি ইতিহাস। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে আজ আমরা অনেকদূর অগ্রসর হয়েছি। তিনি তার স্বপ্ন পূরণ করে যেতে পারেননি। ঘাতকরা তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। কিন্তু আমরা শুরু থেকেই তার স্বপ্ন পূরণে কাজ করে আসছি।
বাবার সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি, দেখা হতো কারাগারে
শৈশবের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ছোটবেলায় শিশুরা তোমরা বাবা মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাও, আমাদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। বাবার সঙ্গে দেখা হতো কারাগারে। মাসে দুইবার জেলগেটে যেতে পারতাম। স্কুল থেকে জেলগেটে গিয়েছি, কলেজ থেকে জেলগেটে গিয়েছি। এই ছিল আমাদের জীবন।’
তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের কোনো ক্ষোভ ছিল না, আমরা জানি আমাদের বাবা সংগ্রাম করছেন দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। স্বাধীনতার পর থেকে তিনি সে প্রচেষ্টাই চালিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির পিতার অবদান ও ত্যাগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই বাঙালি জাতিকে আর্থ-সামাজিক মুক্তি দেওয়ার জন্যই ছিল জাতির পিতার সংগ্রাম। তিনি তার নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করেছিলেন এই দেশের মানুষের জন্য।’
তিনি বলেন, ‘১৯৪৮ সালে মায়ের ভাষা বাংলার ভাষার অধিকার যখন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। তখন থেকে তিনি তার প্রতিবাদ করেন এবং আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেখানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং মাতৃভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার সংগ্রাম শুরু হয়। সেই সংগ্রামের পথ বেয়েই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জন।’
বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মর্যাদা
টানা তিনবারের সরকারপ্রধান আরও বলেন, ‘বাঙালি জাতি যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছে। বিজয়ী জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বে মর্যাদা পেয়েছি। এই বাংলাদেশ একসময় আজকের বাংলাদেশ ছিল না। এমনকি ১৫ বছর আগের বাংলাদেশেও এখনকার বাংলাদেশ নয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, চিকিৎসাহীনতা, গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের ক্রন্দনে বাংলার আকাশ-বাতাস ভারী ছিল। এই বাঙালি জাতিকে আত্মসম্মানে মুক্তি দেওয়ার জন্যই জাতির পিতার সংগ্রাম। জাতির পিতা নিজের জীবনটা উৎসর্গ করেছিল এ দেশের মানুষের জন্য।’
‘আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এই স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং যুদ্ধের জাতির পিতা আহ্বান করেছিলেন ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সংগ্রাম করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। সেভাবে অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে এবং আমরা বিজয়ী হই’-যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কার উন্নয়নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যয় নিতে হবে আজকের বাংলাদেশ যে উন্নত-সমৃদ্ধ হয়েছে যতদূর; আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। এটা ধরে রেখে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
আজকের শিশুরা আগামী দিনের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার সৈনিক মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের আজকের ছোট শিশুরা আগামী দিনের সৈনিক, যারা স্মার্ট বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিনে এবং বাংলাদেশ পরিচালনা করবে। সেভাবেই তোমরা নিজেদের তৈরি করবে।’
শিক্ষা অর্জনে শিক্ষার্থীদের মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, শিক্ষাই জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, কোনো কিছুই সম্পদ না। (আসল) সম্পদ হচ্ছে একমাত্র শিক্ষা। শিক্ষা যে গ্রহণ করবে ভালো ভাবে, এটি কেড়েও নিতে পারবে না, ডাকাতিও করতে পারবে না। এটি নিজের কাছে থেকে যাবে। আর শিক্ষা থাকলে পরে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ করা যাবে।’
অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। এ সময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম মতিউর রহমান, জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও লজিটিক্স এরিয়ার এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মো.মঈন খানসহ সামরিক-বেসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন শ্রেণির স্কুল শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরো মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখেন। পরে তিনি উপস্থিত স্কুল শিক্ষার্থী এবং সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেন।
কালের আলো/এমএএএমকে