আগুন মৃত্যু ও গ্রেফতারে শেষ বিএনপি-জামায়াতের হরতাল

প্রকাশিতঃ 8:41 pm | October 29, 2023

কালের আলো রিপোর্ট:

মহাসমাবেশে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা, অসংখ্য নেতাকর্মীকে আটক ও আহত করার অভিযোগ এনে সারাদেশে রোববার (২৯ অক্টোবর) সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে বিএনপি-জামায়াত। তবে হরতাল ডেকে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতারা ঘরে বসেই সময় পার করেছেন। হরতাল সমর্থনে শুধুমাত্র রাজধানীর নর্দা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। তবে কোথাও কোথাও বাসে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে তাঁরা ঠিকই নাশকতা ঘটিয়েছে। এদিন সকালে ডেমরা বামৈল এলাকায় অছিম পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় হরতাল সমর্থকরা। আগুন দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় একজন নিহতের ঘটনা ঘটে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতাকে।

লালমনিরহাটের মহেন্দ্রনগরে বিএনপির হরতালে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে জাহাঙ্গীর হোসেন (৪২) নামে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। এসময় আহত হয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন। রবিবার (২৯ অক্টোবর) দুপুরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জাহাঙ্গীর হোসেন মারা যান।

অন্যদিকে, হরতাল চলাকালে স্বাভাবিক নিয়মেই চলে সচিবালয়ের কার্যক্রম। রবিবার (২৯ অক্টোবর) নির্ধারিত সময় সকাল ৯টা থেকেই সচিবালয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। তবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বাড়তি নজরদারি দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এদিন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নির্ধারিত সময়েই কার্যালয়ে উপস্থিত হয়েছেন। ঢাকার বাইরেও হরতাল চলাকালে ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ্য করা যায়। হরতাল চলাকালে রাজধানীর জনজীবন ছিল স্বাভাবিক। গণপরিবহন কম চলাচল করেছে। সড়কে ছিল ব্যক্তিগত গাড়িও। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। পুরো সময়ে আতঙ্ক নিয়ে চলাচল করেছে নগরবাসী। ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়নি। ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল ছিল স্বাভাবিক। অনেক দোকান ও বড় বড় বিপণিবিতান খোলা ছিল। হরতালের নামে নৈরাজ্য ঠেকাতে রাজধানীর মোড়ে মোড়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সতর্ক পাহাড়ায় দেখা যায়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নাশকতা ঠেকাতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে টহল দিয়েছে। পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির সদস্যদের তৎপরতা নজরে আসে।

ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন মহাসড়কে যানবাহন কম চলাচল করতে দেখা যায়। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা মতিঝিলে বিরাজ করে থমথমে পরিবেশ। হরতালের ঢিলেঢালা অবস্থায় ছিল রাজধানীর মতিঝিল ব্যাংকপাড়ায়। যদিও স্বাভাবিক নিয়মে চলে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম। সোনালী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সকাল থেকে সব ধরনের সেবা দেন। তবে অন্যান্য দিনের চেয়ে ব্যাংকে গ্রাহকের উপস্থিতি তুলনামূলক অনেক কম ছিল।

রোববার (২৯ অক্টোবর) রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখা যায়, মহাখালী থেকে সদরঘাট ও গাজীপুরের দিকে বাস চলেছে, তবে সংখ্যায় অনেক কম। গণপরিবহন কম থাকায় বিপাকে পড়েন অফিসগামী ও সাধারণ যাত্রীরা। একটি বাস এলে যাত্রীদের গাদাগাদি করে বাসে উঠতে দেখা গেছে।

উত্তরবঙ্গগামী টাঙ্গাইল বা ময়মনসিংহগামী দূরপাল্লার বাসগুলো মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়নি। বাসগুলোকে টার্মিনালে সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। রংপুরগামী এস আর প্লাস পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার ফরিদুল ইসলাম বলেন, দিনের বেলায় এখান থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। তবে, সন্ধ্যার পর থেকে ছাড়তে পারে। মূলত নাশকতার আশংকায় আমরা বাস ছাড়িনি।

টাঙ্গাইল অভিমুখী জলসিঁড়ি পরিবহনের এক কর্মী বলেন, বাস নিয়ে বের হলে ক্ষতি হলে তো আর মালিক পক্ষ দেখবে না। সেটা আমাদেরই দেখতে হবে। তাই বাস নিয়ে বের হইনি।

বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর হরতালের ডাক দিলেও রাজধানী ঢাকা ও আন্তঃজেলা রুটে বাস, মিনিবাস চলাচল অব্যাহত থাকবে বলে জানায় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। শনিবার (২৯ অক্টোবর) ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

মির্জা ফখরুলকে আটক, ৩ দিন অবরোধ কর্মসূচি
হামলা-বিশৃঙ্খলার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গুলশানের বাসা থেকে রবিবার (২৯ অক্টোবর) সকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের একটি দল। সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদন লেখার সময়ও তিনি ডিবি অফিসে রয়েছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিএমপি ডিবি) কার্যালয়ে রবিবার দুপুরে বাসার খাবার খেয়েছেন বিএনপির মহাসচিব।

গোয়েন্দা হেফাজতে নেওয়ার পর মির্জা ফখরুলের স্ত্রী রাহাত আরা বেগম গুলশান নিজ বাসভবনে গণমাধ্যমকে বলেন, ডিবি পুলিশের লোকজন বাসায় এসে মির্জা ফখরুল ইসলামসহ বাসার সবার সাথে কথা বলে। তারপর সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজের হার্ডডিস্ক নিয়ে যায়। ঠিক দশ মিনিট পর আবার ফিরে এসে মির্জা ফখরুলকে নিয়ে যায়। তিনি অসুস্থ, তার চিকিৎসা চলছে, বয়স ৭৫— যদি তারা জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় তাহলে তা শেষ করে তাকে যেন ছেড়ে দেয়।

শুধু মির্জা ফখরুল নয় মির্জা আব্বাসসহ বিভিন্ন বিএনপি নেতাদের বাসায় অভিযান চালিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা। এছাড়া দিনব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে কতজন গ্রেফতার হয়েছে সেই সংখ্যা এখনও জানা যায়নি।সব তথ্য সমন্বয় করে পরে জানানো হবে বলে জানিয়েছে ডিএমপি।

ডিএমপি ডিবির কার্যালয়ের প্রধান ফটকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একজন ব্যক্তিগত সহকারী বলেন, ‘দুপুরে স্যারের বাসা থেকে খাবার এনে দিয়েছি। স্যার সেই খাবার খেয়েছেন।’ খাবারের তালিকায় কী ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাসা থেকে কী খাবার দিয়েছেন সেটা আমি দেখিনি। তবে তিনি আইবিএসের (এক ধরনের পেটের অসুখ) রোগী। বাইরের খাবার খেতে পারেন না। এটা তার বংশগত রোগ। ডিবি অফিসে কেমন দেখেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্যারকে একটি রুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে।

এদিকে, আগামীকাল মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর এবং ১ ও ২ নভেম্বর) দেশব্যাপী সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বিএনপি। রবিবার (২৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা বর্বরোচিত
এদিকে, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাকে বর্বরোচিত উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বিএনপির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলো দেশের মানুষ, মারা গেলেন পুলিশের একজন সদস্য— এখন আবার তারা হরতাল ডেকেছে। পুলিশের মৃত্যুর ঘটনায় পল্টন থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। মামলা শুরু হয়েছে মাত্র, আরও হবে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত সবাই মামলা করবে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

রবিবার (২৯ অক্টোবর) সকাল ছয়টা থেকে শুরু হওয়া হরতালে শুরুতেই রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এছাড়া বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শেখর পরিবহন, মোহাম্মদপুর চার রাস্তার মোড়ে স্বাধীন পরিবহন, মোহাম্মদপুর টাউন হলের সামনে পরিস্তান পরিবহন এবং বংশালে বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া ডেমরায় রবিবার ভোরে দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে নাঈম নামে এক শ্রমিক দগ্ধ হয়ে মারা যায়। মোহাম্মদপুরে বাসে আগুন দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। যদিও বিএনপি দাবি করছে— নিহত ব্যক্তি মো. আব্দুর রশিদ আদাবরের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক।

সারাদেশে বাড়ানো হয় নিরাপত্তা
হরতালকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে বাড়ানো হয় র‍্যাবের নিরাপত্তা। হরতালে জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে সারাদেশে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) রোবাস্ট প্যাট্রল ও গোয়েন্দা নজরদারি কার্যক্রম পরিচালনা করে। সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে রাজধানীতে ৮৭টি টহল ও রাজধানীর বাইরে ১৫৯টি টহলসহ সারাদেশে ২৪৬টি টহল কার্যক্রম পরিচালনা করে র‌্যাব। মাঠে নামানো হয় বিজিবিকেও। রাজধানীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১০ প্লাটুন বিজিবিকে টহল দিতে দেখা যায়। এদিকে, সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ হত্যা, পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ৮৪৯ জনকে আসামি করে শাহজাহানপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান রবিবার (২৯ অক্টোবর) রাজারবাগ পুলিশলাইন্সে নিহত পুলিশ সদস্যের জানাজায় অংশ নিয়ে জানান, যারা বিশৃঙ্খলা করবে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। যারা সমাবেশে বিশৃঙ্খলা এবং পুলিশ হত্যাকাণ্ড ঘটনায় জড়িত সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাদেরকে শনাক্ত করা হবে। শনাক্ত করে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তিনি বলেন, মির্জা ফখরুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।

কালের আলো/ডিএসকে/এমএইচএ

Print Friendly, PDF & Email