পুরনো চেহারায় বিএনপি-জামাত, কাকরাইল-পল্টন-মতিঝিল রণক্ষেত্র
প্রকাশিতঃ 8:45 pm | October 28, 2023

কালের আলো রিপোর্ট:
শান্তিপূর্ণ সমাবেশের আশ্বাস দিয়েছিল বিএনপি। লোক সমাগম হওয়ার কথা শনিবার (২৮ অক্টোবর) দুপুর দুইটা থেকে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে থাকেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তাদের হাতে ছিল লাঠি। কাকরাইল মোড়ে শুরু করেন গাড়ি ভাঙচুর। একটি বাস ও কয়েকটি পিকআপে করে আসা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কাকরাইলে নেমে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে যোগ দিতে যাওয়ার সময় বিএনপির সমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। পরে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে বিএনপি নেতাকর্মীরা গাড়ি ভাঙচুর শুরু করেন। এ সময় প্রধান বিচারপতির বাসভবনের গেটে বিএনপির কর্মীরা ভাঙচুর ও নজিরবিহীন তাণ্ডব চালায়। পরে পল্টন থেকে বিজয়নগর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। বিজয় নগর এলাকায় বিএনপির হামলায় পারভেজ (৩২) নামে ডিএমপি’র এক পুলিশ কনস্টেবল নিহত হন। থেমে থেমে চলা সংর্ঘষে আরও ৪১ পুলিশ সদস্য আহত হন। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ২২ জন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯ জন আহত পুলিশ সদস্য চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর আগে কাকরাইলে পুলিশ বক্সে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগও করা হয়। ঢামেক জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, মৃত অবস্থাতেই ওই পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার মাথায় গুরুতর আঘাত রয়েছে। আমরা ইসিজি করার পর নিশ্চিত হয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করেছি।
পরে রাজধানীর রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতলের গেটে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। হাসাপাতাল গেটে অবস্থান করা অ্যাম্বুলেন্সেও আগুন দিয়েছে তারা। বেলা ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ডিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরাই প্রথমে সরকারি স্থাপনায় হামলা করেছে। বিএনপি কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে করার কথা দিয়েছিল। ডিএমপি কমিশনারের কাছ থেকে তারা এমন শর্তেই অনুমতি নিয়েছে। হঠাৎ করে বেলা ১২টার পর থেকে তারা প্রধান বিচারপতির বাড়ির ফটকে ও জাজেস কোয়ার্টারের সামনে (বিচারকদের বাসভবন) আক্রমণ করেছে। আইডিবি ভবনের সামনে দুটি গাড়িতে আগুন দিয়েছে। বিএনপি নেতা-কর্মীরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে। পুলিশ সেটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে।
ঘটনাস্থল থেকে একাধিক গণমাধ্যমকর্মীরা জানান, প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে বিএনপির নেতাকর্মীরা গাছের ডাল ভেঙে ও হাতের লাঠি দিয়ে নামফলক, গেটে হামলা চালায়। তারা ভেতরে ইট পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এর মধ্যেই কাকরাইল ট্রাফিক পুলিশ বক্সে আগুন দেয় বিএনপির অনুসারীরা। পুলিশ বাধা দিতে গেলে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংর্ঘষ বাধে। এই ঘটনার রেশ ধরে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে।
পুলিশের রমনা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করতে বেশ কয়েক দফায় টিয়ারশেল ছোড়া হয়। দুটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয় বিএনপির সমর্থকরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ার শেল, জল কামান, সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করছে পুলিশ।
এদিকে, নয়াপল্টনে বিএনপি’র শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে ‘আওয়ামী লীগ ও পুলিশের যৌথ হামলা চালিয়েছে’ অভিযোগ এনে আজ রবিবার (২৯ অক্টোবর) সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে বিএনপি। শনিবার (২৮ অক্টোবর) বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়াপল্টনের মঞ্চ থেকে হ্যান্ডমাইকে হরতালের ঘোষণা দেন। পরে বিকাল সোয়া ৩টার দিকে বিএনপির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজেও হরতালের ঘোষণা দেওয়া হয়। হরতাল ঘোষণার পরপরই কাকরাইল মোড় ও হাইকোর্টের সামনে পুলিশ ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। তাদের হামলায় দুজন পথচারী আহত হয়েছেন। আহত পথচারীরা হলেন হলেন- নাসির (৩৫) ও সুজন (৩০)। রাজধানীর আরামবাগেও পুলিশের ওপর ব্যাপক হামলা চালিয়েছে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। এসময় তারা বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছে। আরামবাগে জামায়াতের সমাবেশের শেষ পর্যায়ে হঠাৎ কয়েকজন কর্মী পুলিশকে লক্ষ্য করে অতর্কিতে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করে। পরে পুলিশও লাঠিচার্জ করে। এতে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেয় দলটির নেতাকর্মীরা। এছাড়া রাস্তার পাশের ভবনের ছাদ থেকে ঢিল ছুঁড়তে থাকে পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে। তাদের হামলায় পুলিশের অনেক সদস্য আহত হন।
কার্যত সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায়ে বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশ সংঘাতের মধ্য দিয়ে এদিন পণ্ড হয়ে যায়। সংঘাত সংঘর্ষের কারণে রাত সাড়ে ৭ টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থমথমে অবস্থা ছিল নয়াপল্টনে। রাজধানীর আরামবাগ থেকে নয়াপল্টনের বিএনপির নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। গ্রেফতার আতঙ্কে নয়াপল্টন এলাকা ছেড়ে যান বিএনপির নেতাকর্মীরা।
একই দিনে বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে কাকরাইল, মালিবাগ ও কমলাপুরে রাজধানীতে এক ঘণ্টার মধ্যে তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারে বলাকা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। একই সময়ে কমলাপুরে বিআরটিসির একটি বাসেও আগুন দেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালিদ জানান, বিকেলে মৌচাক ফ্লাইওভারে বলাকা বাসে ও কমলাপুরে বিআরটিসি বাসে আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেছে। আগুনে বাস দুটি পুড়ে গেছে। কীভাবে আগুন লেগেছে, সেই তথ্য পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে, বিকেল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে কাকরাইল মোড়ে একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিএমপির রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, কাকরাইল মোড়ে একটি বাসে আগুনের ঘটনা শুনেছি। আমরা ঘটনাস্থলে যাচ্ছি। তবে কে বা কারা আগুন দিয়েছে সেই তথ্য জানা যায়নি।
অপরদিকে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশেকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। এসময় সাংবাদিকদের কয়েকটি মোটরসাইকেলেও আগুন দেওয়া হয়েছে। মূলত সাংবাদিকরা ছিল বিএনপি-জামায়াতের হামলার প্রধান শিকার। আহত সাংবাদিকরা হলেন: নিউ এইজের আহমেদ ফয়েজ, বাংলা ট্রিবিউনের প্রধান প্রতিবেদক সালমান তারেক শাকিল, ফটো সাংবাদিক সাজ্জাদ হোসেন ও নিজস্ব প্রতিবেদক জোবায়ের আহমেদ, দৈনিক কালবেলার প্রতিবেদক রাফসান জানি, আবু সালেহ মুসা, রবিউল ইসলাম রুবেল এবং তৌহিদুল ইসলাম তারেক, ঢাকা টাইমসের প্রতিবেদক সালেকিন তারিন, ব্রেকিং নিউজের ক্রাইম রিপোর্টার কাজী ইহসান বিন দিদার, দৈনিক ইনকিলাবের ফটোসাংবাদিক এফ এ মাসুম, দৈনিক ইত্তেফাকের মাল্টিমিডিয়ার রিপোর্টার তানভীর আহাম্মেদ, একুশে টিভির রিপোর্টার তৌহিদুর রহমান ও ক্যামেরা পারসন আরিফুর রহমান, দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার সাংবাদিক আরিফুর রহমান রাব্বি, ইত্তেফাকের সাংবাদিক শেখ নাছের ও ফ্রিল্যান্সার মারুফ, ভোরের কাগজের ফটো সাংবাদিক মো. মাসুদ পারভেজ আনিস, নুরুজ্জামান শাহাদাৎ ও ক্যামেরাপার্সন আরিফুল ইসলাম পনিও হামলার শিকার হয়েছেন।
রাফসানের সঙ্গে থাকা কালবেলার জ্যৈষ্ঠ প্রতিবেদক রাজন ভট্টাচার্য জানান, কাকরাইল মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্য় চলাকালে ভিডিও ফুটেজ নিচ্ছিলেন সাংবাদিক রাফসান জানি। পুলিশের ওপর হামলার এই ফুটেজ সংগ্রহকালে বিএনপির কর্মীরা রাফসানের ওপর হামলা চালায়। তিনি আরও বলেন, এ সময় রাফসানের গলায় কালবেলার আইডিকার্ড ঝুলানো থাকলেও তাকে এলোপাথাড়ি মারধর করা হয়। হামলায় তার সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। এছাড়া তার মোবাইল ফোনটিও ছিনিয়ে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। অনেকের অবস্থা গুরুতর।
কালের আলো/ডিএস/এনএল