কার স্বার্থে শিক্ষামন্ত্রীকে ‘টার্গেট’ করেছিলেন সিজিএস প্রধান মঞ্জুর?

প্রকাশিতঃ 1:11 am | October 25, 2023

রাজনৈতিক ভাষ্যকার, কালের আলো:

কর্মের চেয়ে আলোচনা-সমালোচনায় থাকতেই যেন বেশি পছন্দ করতেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের (এনআরসিসি) চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী। বছর বছর নদী রক্ষা নিয়ে গরম গরম কথা বলতেন। তাঁর বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগের শেষ নেই এনআরসিসি’র সাবেক চেয়ারম্যানদেরও। সরকার ও নদী কমিশনের ভেতরে-বাইরেও তার অতিকথন ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে সবাই ছিলেন ত্যক্ত-বিরক্ত। অবশেষে সপ্তাহখানেক আগে তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অবশিষ্ট মেয়াদ জনস্বার্থে বাতিল করে সরকার। এরপর থেকেই টিআইবিসহ অনেক সংগঠন বিতর্কিত মঞ্জুরের পক্ষে সাফাই গাইতে শুরু করেছেন। কিন্তু দিনের পর দিন তাঁর শিষ্টাচার বহির্ভূত কর্মকাণ্ড নিয়ে কেউ টু শব্দটিও করছেন না। প্রশ্ন ওঠেছে, টিআইবি এখন যেসব বক্তব্য দিচ্ছে সেটি কী যুক্তিযুক্ত? কোন তথ্য প্রমাণ তাদের কাছে কী আছে? না কী ড.ইউনুস ঘনিষ্ঠ টিআইবি কারও নির্দেশিত হয়েই মাঠে নেমেছে?

তাচ্ছিল্য করে বক্তব্যে পটু
বছরখানেক আগে বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানকে মোবাইল কোর্টের (ভ্রাম্যমাণ আদালত) মাধ্যমে বিচার করে কারাগারে পাঠানোর কথা বলে প্রথম দফায় বিতর্কের মুখে পড়েন ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী। দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে তাঁর এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াস হিসেবেই বিবেচিত হয়। এরপর চলতি বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে যাঁরা বালু উত্তোলন করছেন, তাঁদের সঙ্গে চাঁদপুরের একজন নারী মন্ত্রীর সম্পর্ক আছে।’

প্রশ্ন ওঠেছে, কোন তথ্য ও প্রমাণ ছাড়াই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা সচিব পদমর্যাদার একজন ব্যক্তি কীভাবে একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মনগড়া অভিযোগ তুলতে পারেন? তাঁর অভিযোগের সত্যতা নিয়েও যারপরেনাই তোলপাড় শুরু হয়। কার স্বার্থে শিক্ষামন্ত্রীকে তিনি ‘টার্গেট’ করেছিলেন, বিভিন্ন পরিমণ্ডলেও এটি আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। পুরো বিষয়টিকে শিষ্টাচার বহির্ভূত বলেও মনে করেন অনেকেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, একজন সচিব কখনোই পাবলিকলি এমন বক্তব্য দিতে পারেন না। তার কোন অভিযোগ থাকলে তিনি অবশ্যই সেটি করতে পারবেন কিন্তু তা হতে হবে একটি নিয়ম এবং প্রক্রিয়া মোতাবেক। তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ পাঠাতে পারতেন। কিন্তু যেভাবে কোন শক্ত প্রমাণ ছাড়াই প্রকাশ্যে অভিযোগ এনেছেন সেটি সম্পূর্ণ শিষ্টাচার বহির্ভূত একটি কাজ। এর পেছনে ওয়ান ইলেভেনের অনির্বাচিত সরকারের কুশীলবদের হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নে অপতৎপরতা
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের (এনআরসিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্নমেন্ট স্ট্যাডিজেরও (সিজিএস) চেয়ারম্যান। এগিয়ে আসা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নানামুখী অপতৎপরতায় মেতে ওঠেছে তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান সিজিএস। বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্ক উসকে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মদদেই কাজ করা এই সংগঠনটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কূটনীতিকদের বাড় বাড়ন্ত দৌড়ঝাঁপে কলকাঠি নাড়ছে। তলে তলে পুরো অপকর্ম বাস্তবায়ন করছিলেন মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী, এমন কথাও চর্চিত।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সিজিএস মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্বিতীয় সিআইএ’ খ্যাত ‘ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি’র (এনইডি) আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত হয়। এটি এনইডি’র সামনের সংগঠন ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ (সিআইপিই) থেকেও তহবিল গ্রহণ করে। যারা ‘বেসরকারি উদ্যোগ ও বাজারভিত্তিক সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করছে’ বলে দাবি করে থাকে।

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন ছবিতে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও একটি চ্যানেলের বিতর্কিত উপস্থাপকের সঙ্গে ড.মঞ্জুর আহমেদ’র গভীর হৃদ্যতার বিষয়টি ফোকাস হয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে পিটার ডি হাসের অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি ও বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদের কর্মকাণ্ড কিংবা সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িত ওই উপস্থাপকের বিষয়ে সবাই ওয়াকিবহাল। সরকারি একজন আমলার এমন দেশবিরোধী অপতৎপরতা জনমনে সন্দেহ-সংশয় তৈরি করে।

মন্ত্রীকে নিয়ে বিষোদাগারের নেপথ্য রহস্য
গ্রহণযোগ্য কোন প্রমাণ ছাড়াই শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনিকে নিয়ে রীতিমতো বিষোদাগার করেন সদ্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হারানো এনআরসিসি’র চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী। দীপু মনি শুধু সরকারের মন্ত্রীই নন তিনি দলীয় সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের চারবারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং জাতীয় সংসদের মনোনয়ন বোর্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। মূলত বিভিন্ন কারণে মহল বিশেষের স্বার্থ রক্ষায় তিনি মন্ত্রীকে হেনস্থা করতেই এমন অপপ্রচারে মেতে ওঠেন।

ফলে বিশ্লেষক মহল মোটা দাগে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এনেছেন। ড. মঞ্জুর বা অন্য কারও কাছে কি কোন প্রমাণ আছে যে কেউ অবৈধভাবে বালু তুলছিল বা নদী দখল করেছে এবং প্রশাসন বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ ব্যবস্থা নিতে গেছে এবং মন্ত্রী সেখানে বাধা দিয়েছেন? এমন নজির কী আছে? ডা: দীপু মনিকে নিয়ে তিনি পাবলিকলি গোয়েবলসীয় কায়দায় প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর মাত্র তিনদিন আগে ঢাকার চীনা দূতাবাসের আয়োজনে বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ইন বাংলাদেশ: অ্যাচিভমেন্টস অ্যান্ড ওয়ে ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক সেমিনার ও রিপোর্ট উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন মন্ত্রী।

চীনের সেই অনুষ্ঠানে যাওয়ার জেরেই কী মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্নমেন্ট স্ট্যাডিজেরও (সিজিএস) চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুরের গাত্রদাহ তৈরি হয়েছে? ডা: দীপু মনির আসনে মনোনয়ন স্বপ্নে বিভোর এক কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাও কী এসব অপতৎপরতার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন, এসব প্রশ্নও এখন অন্দরে-বাইরে উচ্চারিত হচ্ছে। সরকারের যেসব মন্ত্রী পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির তাদের একজন ডা: দীপু মনি। কিন্তু তাঁর ট্র্যাক রেকর্ড জেনেও কেন তাকে বারবার অপকৌশল থিওরিতে জেরবার করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চলছে এমন প্রশ্নও মুখে মুখে ফিরছে।

কালের আলো/আরআই/এএইচ

Print Friendly, PDF & Email