স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্ফালন রুখে দেয়াই হোক বিজয়ের ঐকান্তিক অঙ্গীকার 

প্রকাশিতঃ 10:53 am | December 16, 2022

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:

মুক্তিযুদ্ধ দেখা হয়নি আমার। কারণ আমার জন্ম হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের এক যুগেরও কিছু পরে। বই-পুস্তক, নাটক আর চলচ্চিত্রের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি কিংবদন্তিদের মুখে। এখনো মহান বিজয় দিবস এলেই আমার বড় বেশি মনে পড়ে যায় একাত্তরের কথা। আমি বাঙালি জাতির সূর্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মুখ থেকেই অনেকবার শুনেছি অগ্নিঝরা দিনগুলোর খন্ড খন্ড স্মৃতি। একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর সেনানীরা বলতেন আর এক অদৃশ্য সেলুলয়েডে আমি মনে আঁকতাম মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকল্প।

আমাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ঘটনা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ধন্য সেই পুরুষ, বাঙালি জাতির ইতিহাসের মহান নেতা, মহাবীর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্নসাধ পূরণ হয়েছে বিজয়ের মাসে। বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় গৌরবদীপ্ত চূড়ান্ত বিজয় ১৬ ডিসেম্বর।

সেই শৈশবেই নিজের পরিবার থেকে জেনেছি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন ও বর্বরতার দীর্ঘ অধ্যায়ের বাস্তব চিত্র। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক তেজোদীপ্ত ভাষণের পর গ্রামে গঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠকদের মাধ্যমে প্রস্তুতি চলছিল। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ আমার নিজ জেলা ময়মনসিংহ শহরের খাগডহরে রাতভর যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধের খবর ছড়িয়ে পড়লে এখানকার প্রতিটি উপজেলার গ্রামের পর গ্রামে মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য যুবকদের মাঝে সাড়া পড়ে যায়। ওই সময় গ্রামের ধনাঢ্যদদের থ্রি-ব্র্যান্ড রেডিও ছিল। রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনা তখন যুদ্ধ অবরুদ্ধ মানুষজনের কাজ ছিল। সন্ধ্যার পরপরই স্থানীয় গ্রামের মানুষজন জড়ো হতেন সেখানে। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া না হলেও অনেকেই ও তার সমবয়সীরা খেলতেন ‘যুদ্ধ।’ বড়রা যখন দেশের খবর বলতো তখন তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনার মাস মার্চ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবানও এসেছিল এই মাসেই। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুক্তিকামী বাঙালির ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তারা উদ্দীপ্ত হন। জেগে উঠে বাঙালি জাতি। হায়েনাদের বিপক্ষে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে শুরু হয় প্রস্তুতি। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নিতে জাতির অবিসংবাদিত নেতা, রাজনীতির মহানায়ক, অমর-অব্যয় কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উচ্চারণ করলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি….।’

ঐতিহাসিক এই ভাষণে বাঙালি জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিলেন। ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিরা নৃশংসতম, পৈশাচিক ও বর্বর কায়দায় হাজার হাজার নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করলো। ঘৃণ্যতম গণহত্যার মধ্যরাতেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। ত্রিশ লাখ প্রাণের আত্মদান এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে নয় মাসের রক্তয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর বিজয়ের প্রভাতী সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল শিশির স্নাত মাটি। পাকিদের হটিয়ে মুক্তির স্বাদ নিয়েছিল বীরের জাতি বাঙালি। অর্জিত হয়েছিল চির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটলো স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের।

মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির অজুত ব্যর্থতা আর নানা কারণে ৭১’র পরাজিত শক্তি আবারো স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে ভয়ঙ্কর থাবা বসিয়েছিল। হয়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ। লাল-সবুজের পতাকার বিরোধীতাকারী ওই সামরিক জান্তার বিষবৃক্ষরাই দোর্দন্ড প্রতাপে নিজেদের গাড়িতে উড়িয়েছে লাখো শহীদের রক্তে কেনা পতাকা। বিলম্বে হলেও সেই কলঙ্ক মোচনের পাশাপাশি বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরার যুদ্ধ শুরু করেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।

স্বাধীনতা বিরোধী শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে নতুন যুগের সূচনা। লাল সবুজের পতাকাও যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নতুন প্রজন্ম দেশকে ভালবাসে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যদিক দিক ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। ক্রীড়া, সংস্কৃতি, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা।

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে দেশপ্রেমের চেতনা। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও মর্যাদা আমাদেরই সমুন্নত রাখতে হবে। একটি সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চায় নতুন প্রজন্ম। যেখানে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলবে। জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ ঠাঁই পাবে না। থাকবে শুদ্ধ রাজনৈতিক পরিবেশ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, নিজস্ব স্টাইলে। আপন মহিমায় মাথা উঁচু করে। উন্নয়নের বহমান এই ধারা অব্যাহত থাকুক। মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম ত্যাগ আর বীরত্বগাঁথা অটুট থাকুক। পাকিপ্রেমীরা নির্বাসিত হোক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শাণিত করে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের দোসরদের আস্ফালন রুখে দেয়াই হোক এবারের বিজয় দিবসে আমাদের ঐকান্তিক অঙ্গীকার। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হউক।

কালের আলো/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email