রেল নেটওয়ার্ক সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে

প্রকাশিতঃ 10:06 am | December 15, 2022

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:

রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আসছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। চলমান রয়েছে ১০২ কিলোমিটারের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প বাস্তবায়ন। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন যাবে কক্সবাজারে। ২০২৩ সালের জুনেই এই পথে চলবে ট্রেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার এই প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। করোনার প্রভাবে কাজের গতি মন্থর হলেও সেটি কাটিয়ে এখন কাজ চলছে পুরোদমে। দিন-রাত চলছে নানা কর্মযজ্ঞ। প্রকল্পের কাজ শেষ হলেই দেশের অর্থনীতির গতির পাশাপাশি সড়কপথে পাঁচ-ছয় ঘণ্টার দূরত্ব রেলপথে অর্ধেকে নেমে আসবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেনে পর্যটকদের টানতে কেনা হচ্ছে ৫৪টি অত্যাধুনিক ট্যুরিস্ট কোচ। সুপ্রশস্ত এসব কোচে বসে পর্যটকরা পাহাড়ঘেরা পথের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, পর্যটন নগরীর প্রতিনিধিত্ব বোঝাতে সমুদ্রসৈকত থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে নির্মাণ হচ্ছে ‘ঝিনুকাকৃতির’ রেলস্টেশন। এটিই হবে দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন। স্থানীয় ঝিলংঝা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়া এলাকায় প্রায় ২৯ একর জমির ওপর পুরো স্টেশনটি গড়ে উঠছে। ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুটের এই আইকনিক স্টেশন ভবনটিতে থাকবে অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে স্টেশন নির্মাণ।

দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় রুট হবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ, এমনটিই মনে করেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, ‘এই রুটে সাধারণ ট্রেনের সঙ্গে বিশেষ পর্যটন ট্রেনও চলবে। এ জন্য অত্যাধুনিক কোচ সংগ্রহ করা হচ্ছে। উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরাও অনায়েসে ট্রেনে কক্সবাজার যেতে পারবেন। সাধারণ মানুষ স্বল্প খরচ ও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও সেবায় কক্সবাজারে যেতে পারবেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিচারে সেই পথ হবে মনোরম।’

রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এতে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড পৃথক দুই ভাগে কাজটি করছে। এটি সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।

সূত্র জানায়, পুরো প্রকল্পে ৩৯টি মেজর ব্রিজ এবং ২৪২টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশনসহ সব মিলিয়ে নয়টি স্টেশন থাকবে রেলপথটিতে। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের দিকে পরের স্টেশনটি রামু। এরপর পর্যায়ক্রমে থাকবে ইসলামাবাদ, ডুলাহাজারা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারী রেলওয়ে স্টেশন।

চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন যেন কক্সবাজারবাসীর জন্য স্বপ্নের মতো। এখন এই স্বপ্ন হচ্ছে সত্যি। কক্সবাজারে ট্রেন চলাচলে পাল্টে যাবে অর্থনীতির চাকা। স্বভাবতই এ নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর। তিনি বলেন, ‘নদী-নালা-খাল বিল, পাহাড় ঘেঁষে হচ্ছে স্বপ্নের এই প্রকল্প। ২০২৪ সালের জুনে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আমরা আগামী বছরের জুনে কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়েছি। ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড দুই ভাগে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রুত কাজ বাস্তবায়ন করছে।’

প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে বলে জানান চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অনেকটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই নির্ধারিত সময়ের আগে আমরা কাজ শেষ করতে যাচ্ছি। বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে কোচগুলো সংগ্রহ করছি। অত্যাধুনিক কোচ হবে অনন্য এবং অসাধারণ। যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো ৮০ কিলোমিটার এবং পর্যটন ট্রেন ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতি নিয়ে চলাচল করবে।’

রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী বলেন, ‘এই রুটে অত্যাধুনিক ট্রেন চলাচল করবে। আমরা আধুনিক কোচ সংগ্রহ করছি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এবং পুরো রেলপথও ডুয়েল গেজে রূপান্তর করা হচ্ছে।’

দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন
শুভ্র সাদা বিশাল আকৃতির এক ঝিনুক। এর ভেতরে আসা যাওয়া করবে ট্রেন। এমন দৃশ্য বাস্তব হতে চলেছে সৈকত শহর কক্সবাজারে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের আওতায় চলছে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশনের নির্মাণ কাজ। স্টেশনের প্রায় ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। এই পথে হাতি চলাচলের জন্য আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে।

শুধু কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনটি নির্মাণ করতেই ২১৫ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রেলের কর্মকর্তারা। কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টেশনটিতে যাত্রী প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য রাখা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন পথ। থাকছে গাড়ি পার্কিংয়ের বড় জায়গা। আইকনিক রেলস্টেশনটিতে থাকছে তারকা মানের হোটেল, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, শিশু যত্ন কেন্দ্র। থাকছে লকার বা লাগেজ রাখার স্থান। রাতের ট্রেন ধরে সকালে কক্সবাজারে গিয়ে পর্যটকেরা লাগেজ, মালামাল স্টেশনে রাখতে পারবেন। আর সারাদিন সমুদ্রসৈকত বা দর্শনীয় স্থান ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরে পারবেন নিজ গন্তব্যে।

কালের আলো/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email