কথিত মানবাধিকার ও গণতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের ‘হাতিয়ার’!

প্রকাশিতঃ 7:35 pm | October 10, 2022

কালের আলো রিপোর্ট :

যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত- এই চার দেশের সামরিক জোট, কিউএসডি বা কোয়াড নামে পরিচিত। মূলত ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীনের প্রভাব রুখতেই ২০০৭ সালে আবির্ভাব ঘটে কোয়াডের। চীন বরাবরই বলে আসছে কোয়াড হচ্ছে ‘এশীয় ন্যাটো’। বাংলাদেশকে সাম্প্রতিক সময়ে কোয়াডে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন আহ্বান জানিয়ে চলেছে মহাপরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ শান্তির পক্ষে, ভারসাম্যের কূটনীতি বজায় রেখে এখন পর্যন্ত সেখানে যোগদান করেনি।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ কখনও কোন সামরিক জোটে যুক্ত হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী যে কোন দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্কে বিশ্বাসী বাংলাদেশ। কূটনীতির পরিভাষায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে কোয়াডে যোগ দেয়ার কথা ভাবছে না। এমন কি কোয়াডের অন্য সদস্যদের থেকে সেখানে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ বা প্রস্তাবও আসেনি। তবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং এ ব্যাপারে অন্য কোন দেশ কিছু বলার বা বাধা দেয়ার অধিকার রাখে না বলেও সাফ জানান মন্ত্রী।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সুশাসন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বেশ লম্ফঝম্ফ করছে যুক্তরাষ্ট্র। কূটনীতিকরা মনে করেন, বাংলাদেশ কোয়াডে যুক্ত না হওয়াতেই বেজায় চটেছে মার্কিন মুল্লুক। র‍্যাবের বর্তমান ও সাবেক ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশকে গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ না জানানো মূলত কোয়াড ইস্যুরই প্রতিফলন।

অথচ মানবাধিকারের এই কথিত ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র নিজ ভূখণ্ডে প্রতিবছর হাজারেরও বেশি মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে গুলি করে হত্যা করে। দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী প্রকাশ্যে এই নজিরবিহীন মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও টু শব্দটি করে না বাইডেন প্রশাসন। সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে নাগরিকদের মৃত্যুর ঘটনার অর্ধেকই ওঠে না সরকারি রেকর্ডে। ১৯৮০-২০১৮ সালের মধ্যে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর ৫৫ শতাংশ ঘটনার রেকর্ড নেই সরকারি নথিপত্রে।

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন মোতাবেক, যুক্তরাষ্ট্রে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। তবে পুলিশের গুলিতে তাদের মৃত্যুর হার শ্বেতাঙ্গদের থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। প্রতি মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুলিশের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুর হার ৪১ জন। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে এই হার প্রতি মিলিয়নে মাত্র ১৬ জন।

কূটনীতিকরা অভিযোগ করে বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনই। নিজেরা যখন কোন পরিকল্পিত এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে না পারে তখনই তাঁরা মানবাধিকার ও সুশাসনের বুলি আওড়াতে শুরু করে। অর্থাৎ, একটি দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করে দেশটি। উদাহরণ টেনে তারা বলেন, বাংলাদেশের র‍্যাবের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা তাদের এই অপকৌশলের নামান্তর। অন্যান্যদের মতো তারা বাংলাদেশকেও এভাবেই চাপে রাখতে চায়। মানবাধিকার প্রশ্নে তারা নানা রকম তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই দেশটির রাষ্ট্রদূত গরম গরম কথা বলছেন।

সম্প্রতি র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সমস্যা থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সময়-সময় আমাদের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা ও একসময় জিএসপি বাদ দিল। অনেক সময় নানা ঘটনা ঘটায়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমার দেশেরই কিছু লোক, তারা যেসব অঙ্গরাজ্যে থাকেন, সেখানকার সিনেটর-কংগ্রেসম্যানের কাছে নানা মিথ্যা তথ্য দেন। যারা এগুলো করে, তারা অপকর্ম করেই দেশ ছাড়ে। কোনো না কোনো অপরাধে তারা অপরাধী অথবা চাকরিচ্যুত।’

শেখ হাসিনার মতে, র‌্যাব সৃষ্টি হয়েছে আমেরিকার পরামর্শে। আমেরিকাই তাদের ট্রেনিং দেয়। অস্ত্রশস্ত্র, হেলিকপ্টার এমনকি ডিজিটাল সিস্টেম, আইসিটি সিস্টেম সবই আমেরিকার দেয়া। আমেরিকা যেমন ট্রেনিং দিয়েছে, র‌্যাব তেমন কাজ করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবার বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন কৌশল প্রয়োগ করতে সক্রিয় রয়েছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক নামে নতুন এক অর্থনৈতিক জোট গঠন করেছে তাঁরা। এই জোটে বাংলাদেশকে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে এই বিষয়ে প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। বাইডেন প্রশাসন প্রথম পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্র্রেলিয়ার সমন্বয়ে অর্থনৈতিক বলয়ের যাত্রা শুরু করতে চাইছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশকে ফ্রেমওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাবও দিয়ে রেখেছে। এমন খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। তবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আগ্রহ কিংবা অনাগ্রহ কোনোটিই দেখায়নি।

কালের আলো/ডিএ/এমএম

Print Friendly, PDF & Email