পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনকে নিয়ে কী এবার ‘অপপ্রচার’ থামবে?

প্রকাশিতঃ 9:50 pm | September 06, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক ভারত সফরের সঙ্গী হতে পারেননি। অসুস্থতাই শেষতক কাল হয়েছে। আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে নিজে সরকারপ্রধানের সফরসঙ্গী হবার কথা জানালেও পরের দিনেই সব উলট-পালট! কেন সফরে নেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন- এ নিয়ে রাজ্যের প্রশ্ন। তুমুল কানাঘুষা।গণমাধ্যমে শুরু হলো রীতিমতো ‘ময়না তদন্ত’। একের পর এক বিষমাখা তীরে বিদ্ধ মন্ত্রী।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, মন্ত্রী অসুস্থ থাকার কারণে সফর নির্ধারিত থাকার পরও যাননি। কিন্তু হাসি-তামাশায়, অচ্ছুত কায়দায় উড়িয়েই দিয়েছেন কেউ কেউ। মঙ্গলবার (০৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে একই বিষয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ যুক্তি দিয়ে বিষয়টিকে খোলাসা করলেও সম্ভবত অনেকেরই মন-পুত হয়নি।

আওয়ামী লীগের অত্যন্ত প্রভাবশালী এই রাজনীতিক তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সমসাময়িক বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেছেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন কিছুটা অসুস্থ বলে ভারত সফরে যেতে পারেনি। অসুস্থ থাকলে অফিস করা যায়, কিন্তু এত হাই-লেভেল (উচ্চ পর্যায়ের) ভিজিট করা কঠিন।’

সরকারের মুখপাত্রের এমন সুস্পষ্ট বক্তব্যের পরেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রচার করা হয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনকে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। উঠে অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার গল্প। আগ বাড়িয়ে কারও কারও মন্তব্য ছিল-দপ্তর বদল বা এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকলেও তাকে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হবে। গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সেখানে ড.মোমেনের মতো ঝানু কূটনীতিককে নিয়ে নিজেদের মতো করেই নেতিবাচক উপমা, উৎপ্রেক্ষায় পিন্ডি চটকানোর তুঘলকি কারবারের কসরত দৃশ্যমান ছিল সোমবার থেকে মঙ্গলবার দিনমান! ভাবখানা এমন নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করতেই কীনা সবাই ব্যস্ত-সমস্ত। কী ভয়ানক তর্জন-গর্জন। মহামতি আলেকজেন্ডারের ভাষায় ‘সত্যিই কী সেলুকাস!’

অত:পর মঙ্গলবার সন্ধ্যা নাগাদ দৃশ্যপট পরিবর্তিত।রক্তচাপজনিত সমস্যা থাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) সকালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) গিয়েছিলেন। মন্ত্রীর চিকিৎসা সম্বলিত ছবি ও খবর গণমাধ্যমে ফলাও করেই প্রচার হয়েছে। এতে হয়তো অনেকেরই হুঁশ ফিরেছে। প্রায় ৪০ ঘন্টারও বেশি সময় নিজেদের মনমতো কথার তুবড়ি ছুটিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন যারা সেই তারাই কীনা ভারমুখেই উচ্চারণ করছেন, মন্ত্রী সত্যিই অসুস্থ! পরিস্থিতি ঠিক যেন অনেকটাই এমন- ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিলো সে মরে নাই!’ অর্থাৎ, গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশের আগ পর্যন্ত অর্বাচীন সম্প্রদায়ের বিশ্বাসই হয়নি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অসুস্থ। প্রশ্ন উঠেছে, এখন কী তারা হীন কায়দায় অপপ্রচারের জন্য দু:খ প্রকাশ করবেন? অহেতুক সমালোচনার বিষাক্ত তীর ছুঁড়া বন্ধ করবেন?

একজন মানুষ অসুস্থ হতেই পারেন। চলতি বছরের মার্চেও তুরস্ক সফর শেষে দেশে ফেরার সময় বিমানে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পরে সিএমএইচে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন এবং সুস্থ হয়ে উঠেন। কিন্তু এবার ভারত সফরকে ঘিরে আগে থেকেই তাকে বিতর্কিত করতে সংসদের বাইরের দল বিএনপি ও তাদের হালুয়া-রুটিতে নাদুস নুদুস একশ্রেণির বিদ্যাজীবী, বুদ্ধিজীবীরা আদাজল খেয়েই যেন মাঠে নেমে পড়েন। এই বিশেষ মহলটি আদতে ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। মূলত তারা ফখরুল-রিজভীদের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে ছবক দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এদেরকেই কীনা প্রখ্যাত ইতিহাসবীদ ও শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অবয়বে বাঙালি’ বা ‘আর্টিফিসিয়াল বাঙালি।’

ড. এ কে আব্দুল মোমেনের দেশের মাটিতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়ানোর আগেও একটি বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার ছিল। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম স্টাইলে নয়, নিজের অপরিমেয় মেধার দ্যুতি, যোগ্যতা ও পরীক্ষার প্রমাণ দিয়েই বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন জয় করেছেন। রাজনীতিতে উচ্চ আসন অলঙ্কৃত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়কাল থেকেই। দীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধুর স্নেহ সান্নিধ্যে থেকেছেন। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রেও ওয়ান ইলেভেনে কারান্তরীণ শেখ হাসিনা মুক্তি আন্দোলনে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। বহিরাঙ্গে নয়, বঙ্গবন্ধুকন্যাকে অন্তরেই ধারণ করেন। তার দেখানো পথেই সমর্পিত করেছেন নিজেকে।

সাম্প্রতিক সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দু’টি বক্তব্যকে ‘টুইস্ট’ করে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশার মাধ্যমে একটি মহল আত্মতৃপ্তির ভেলায় ভাসিয়েছেন নিজেদের। আপাদমস্তক ভদ্র, বিনয়াবনত ও সজ্জন ড.মোমেন হাসিমুখেই সব মেনে নিয়েছেন। বারবার নিজের বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপনের কথা বলেছেন। কিন্তু ঘৃণ্য কায়দায় কাউকে আঘাত করেননি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে অপপ্রচার বিলিয়ে বেড়ানো মহলটি ভারত সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশটির একজন প্রতিমন্ত্রীর অভ্যর্থনা জানানো নিয়েও মিথ্যার বেসাতি করে বেড়াচ্ছেন। অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে প্রটোকল মেনেই প্রধানমন্ত্রীকে দিল্লি বিমানবন্দরে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। ফ্রান্স, কানাডা, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, জাপান-বিশ্বের সব দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের এভাবেই বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানানোর রীতি রয়েছে ভারতে।

এ সম্পর্কে সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ আরাফাত একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন ফেসবুকে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরং প্রটোকল ভেঙ্গে তিন বার বিমানবন্দরে গিয়ে কোনো সরকার প্রধানকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। এরমধ্যে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা বরং ৩ জন বিশ্ব নেতার একজন যাঁকে ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রটোকল ভেঙে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিমানবন্দরেই উপস্থিত হয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। আমাদের দেশের প্রটোকল ভিন্ন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দরে স্বাগত জানায়।’

সংসদে বিএনপির এমপি রুমিন ফারহানা ও হারুন অর রশিদ দেশ শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে বলে মুখে ফেনা তুলেন। আসলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেন শ্রীলঙ্কার মতো হচ্ছে না এটি নিয়ে তাদের মনোবেদনার শেষ নেই। এই গোত্রের কেউ কেউ রাতে ঘুমাতে যান বুকভরা আশা নিয়ে যেন ঘুম থেকে জেগে শুনবেন বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আসলে ৭১ ও ৭৫’র খুনি চক্রই নিজ দেশের সর্বনাশ জপেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় ওদের ‘দিল মে হ্যায় পেয়ারে পাকিস্তান।’ এই ছদ্মবেশীরাই সততার শক্তিতে বলীয়ান ড.মোমেনের বহুমুখী পান্ডিত্য ও কূটনৈতিক দক্ষতায় ঈর্ষাকাতর হয়ে ঘৃণ্য কায়দায় তাকে হেনস্থা করার অপচেষ্টা করেন। এই চক্রটিই প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে প্রটোকল নিয়ে মিথ্যাচার করেন। তাদের ভাবখানা মিথ্যাবাদী রাখাল ও বাঘের শিশুতোষ গল্পের কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। সতের কোটির বাংলাদেশ এই অপশক্তির দূরভিসন্ধিমূলক কথাবার্তা ও অপপ্রয়াসকে ঘৃণাভরেই প্রত্যাখ্যান করেছে।

কালের আলো/এএএমকে

Print Friendly, PDF & Email