আগুন লাগার পর গেটে তালা দেওয়ায় শ্রমিকরা বের হতে পারেনি
প্রকাশিতঃ 8:54 am | July 10, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:
আগুন লাগার শুরুর দিকে হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কারখানার তিনতলা ও চারতলার কলাপসিবল গেট শ্রমিকেরা খুলে দিতে বললেও কর্তৃপক্ষ তা খুলে দেয়নি। এ কারণেই এই দুই ফ্লোরের শ্রমিকরা বেশি মারা গেছেন বলে মনে করেন ভুক্তভোগী শ্রমিকেরা।
আরও পড়ুন: অবহেলায় শ্রমিকের মৃত্যু: দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে
শুক্রবার (০৯ জুলাই) ঘটনাস্থল ঘুরে, স্থানীয় লোকজন ও ভুক্তভোগী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা এমনটাই জানা গেছে।
ফায়ার সার্ভিস জানা, বৃহস্পতিবারের (৮ জুলাই) আগুনে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সেজান জুস কারখানায় এখন পর্যন্ত ৫২ শ্রমিকের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।অধিকাংশ মরদেহই ভবনটির দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
উপস্থিত অনেক শ্রমিকের দাবি, এখনো অনেক শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন। তবে তাদের অবস্থান কত তলায় তা নিশ্চিত করতে পারেননি তারা।
ঘটনাস্থলে নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনেরা জানান, যখন ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয় তখন কর্তৃপক্ষ তিন ও চারতলার দুই সেকশনেরই কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয়। এতে ভেতরে প্রায় ১০০ শ্রমিক আটকা পড়েন। ভেতর থেকে তারা কেউই বের হয়ে আসতে পারেননি। তাদের মধ্যে দুই একজন লাফিয়ে নিচে পড়ে জীবন রক্ষা করতে পারলেও গুরুতর আহত হয়েছেন।
স্বজনদের অভিযোগ, আগুন লাগার পর কারখানা কর্তৃপক্ষকে বার বার তিন ও চারতলার কলাপসিবল গেট খোলার আকুতি জানালেও তা খোলা হয়নি। কারখানার লোকজন যদি সময়মতো গেট খুলে দিত তাহলে এত শ্রমিকের প্রাণহানি হতো না। আগুন লাগার পরপরই তারা বেরিয়ে আসতে পারত।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগুন প্রথম দিকে কম ছিল। ধীরে ধীরে বেড়েছে। কারখানার গেট খোলা থাকলে শ্রমিকরা বেরিয়ে আসতে পারতেন। অন্তত প্রাণহানি অনেক কম হতো।
কিন্তু শ্রমিকদের আহাজারি শুনলেও তাদের কিছু করার ছিলো না বলে দাবি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় দোকানি।
কারখানার সামনে নিখোঁজ মেয়ের সন্ধানে বসে আছেন কিশোরগঞ্জের বাচ্চু মিয়া। তাঁর মেয়ে তাসলিমা আক্তার (১৮) আগুনের ঘটনায় এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
সন্তানের শোকে পাগলপ্রয়ায় বাচ্চু বলেন, আমার মেয়ে ও আমার স্ত্রী গত এক বছর ধরে কারখানায় কাজ করে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) সকাল ৮টার দিকে তারা কারখানাটিতে কাজে যায়। রাত ৮টায় তাদের শিফট শেষ হওয়ার কথা ছিল। আমার স্ত্রী কারখানার দোতলায় কাজ করত। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে সে দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে। সামান্য আহত হলেও সে প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু আমাদের মেয়ে কারখানার চারতলায় কাজ করে, সে বের হতে পারেনি।
‘কারখানার লোকজনের কাছে আমার স্ত্রী শুনেছে, চারতলার গেট আটকা থাকায় ভেতরের কেউ বের হতে পারছে না।’
তিনি বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসি। এখানে থাকা শ্রমিকরা আমাকে জানান, চারতলার শিফট ইনচার্জ গেট বন্ধ করে দেয় এবং ভেতরে থাকা শ্রমিকদের বলে, ‘নিচতলায় আগুন লেগেছে, আগুন নিভে যাবে; তোমাদের কোনো সমস্যা নেই। তোমাদের বের হতে হবে না।’
বাচ্চু মিয়া জানান, শিফট ইনচার্জের এমন কথায় ভেতরে থাকা সবাই নিশ্চিন্তে কাজ করতে শুরু করে আবার। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে যখন আগুন চারতলায় চলে যায়, তখন আর ভেতর থেকে কেউ বের হতে পারেনি।
রূপগঞ্জের বড়পা এলাকার বাসিন্দা মো. হুমায়ুন কবিরের শ্যালিকা মাহমুদা (১৪) কারখানার তিনতলায় কাজ করতেন। আগুন লাগার পর থেকে তিনিও নিখোঁজ আছেন।
হুমায়ুন কবির বলেন, ‘তিনতলা থেকে বের হয়ে আসা এক নারী শ্রমিক আমাকে জানান, আগুন লাগার আগে তিনি (ওই নারী) কোনো মতে দৌড় দিয়ে বের হয়ে আসেন। তিনি আসার পরপরই তিনতলার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা গেট বন্ধ করে দেয়। ফলে ভেতরে ৫০ থেকে ৬০ জন শ্রমিক আটকা পড়ে। এদের মধ্যে আমার শ্যালিকাও রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘তারা যদি গেট বন্ধ করে না দিত তাহলে সবাই বের হয়ে আসতে পারত এবং জীবন বাঁচাতে পারত। কিন্তু সিকিউরিটি গার্ডরা নিজেরা গেট লাগিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে। কাউকে বের হওয়ার সুযোগ দেয়নি।’
জানা যায়, আটকে পড়া এবং নিহত শ্রমিকদের অধিকাংশই শিশু-কিশোর। যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে।
ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (অপারেশন্স) দেবাশীষ বলেন, ‘তিন ও চারতলা থেকে অধিকাংশ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ভবনটিতে পর্যাপ্ত সিঁড়ি ছিল না। সেজন্য শ্রমিকরা চাইলেও দ্রুত নামতে পারেননি।
কালের আলো/ডিএসকে/এমএম