অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতার খতিয়ানও কম নয়
প্রকাশিতঃ 6:07 pm | August 08, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
জুলাই গণঅ্যভুত্থানে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদচ্যুত হওয়ার পর গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে এই সরকার গঠন করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তি হয়েছে আজ। রাষ্ট্র ও সমাজের বৈষম্য দূর, মৌলিক সংস্কারসহ মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গঠিত সরকারের সফলতা এবং ব্যর্থতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। এগিয়ে চলছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নের বিচারের কাজও।
এক বছরের পথ চলায় রাজনৈতিক পরিসরে সবচেয়ে আলোচিত এসব বিষয়ে যে অগ্রগতি হয়েছে তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। সরকারে তরফে ১২টি ‘অর্জনের’ কথা তুলে ধরা হয়েছে ইতোমধ্যে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ও জনপরিসরে সরকারের এক বছরের কাজের যে মূল্যায়ন আসছে সেখানে ব্যর্থতার খতিয়ানও কম নয়।
রাজনীতির বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষভাবে সাজাতে হবে, কাজ করার তাগাদা তৈরি করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যক্তি বদল হয়েছে, ক্ষমতার একটা চর্চা এখনও আছে।’
বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ‘মব’, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটেই চলছে। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য কমেনি। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিনিয়োগ বাড়েনি। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। বেকারত্ব কমেনি উলটো বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
আবার ব্যর্থতার পাশাপাশি এই সরকারের অনেক সফলতাও রয়েছে। বড় সাফল্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মাথায় জাতীয় নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণা। নির্বাচনি প্রক্রিয়া, সংবিধানসহ মৌলিক সংস্কার ও বিচার কার্যক্রমে বড় অগ্রগতি হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে সরকার ও ইসি। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। দেশের ভেতর ও বাইরের নানা সংকটে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে বসাতে পেরেছে এই সরকার। রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়মিত কাজগুলো অব্যাহত রেখেছে। অর্থনৈতিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিচার ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। এখন চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ। আসামিদের মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন। বাকি দুজনকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার কার্যক্রম চলছে। আন্দোলন দমনে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসেবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়।
অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। প্রধান প্রধান সংস্কার কমিশনগুলো যে সুপারিশ পেশ করেছে, সেগুলোর মধ্যে ‘স্বল্প সময়ের মধ্যে আশু বাস্তবায়নযোগ্য বহু সংস্কার’ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘এই সংস্কারগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক খাত, বিচার ব্যবস্থা ও জনপ্রশাসনে গতিশীলতা আসবে; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি হ্রাস পাবে।’
সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়, যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। আর্থিক খাতে সংস্কার এবং বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে উদ্যোগ দেওয়ার কথা বলে আসছে অন্তর্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া আর্থিক খাতের দুর্নীতি নিয়ে একটি শ্বেতপত্রও প্রকাশ হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। মূল্যস্ফীতি কমে আসা, রপ্তানি বাজারে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, ৪০০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, নতুন করে বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পারা এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সরকারি উদ্যোগের কথা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতির সূচক বলছে, ডলারের উচ্চমূল্যের জন্য রেমিটেন্স প্রবাহ তার অন্যতম। এর ফলে রিজার্ভ, দেশের আমদানি ও রপ্তানির ব্যালেন্স অফ পেমেন্টে ইতিবাচকতা দেখা গেছে। এর বাইরে রপ্তানিতে সুখবর মিললেও শঙ্কা কাটেনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূরক শুল্কের কারণে। অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ককে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে সরকার।
গণঅভ্যুত্থানে গঠিত এই সরকারের কাছে মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা থাকলেও তা পূরণ হয়নি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনগণের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা থাকে। পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে এতসব রক্তদান, আত্মাহুতি, সাহসিকতা এবং বীরত্বের পরও আমাদের যে প্রত্যাশা সেটা পূরণ হচ্ছে না। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আমলাতন্ত্র ও পুলিশ বাহিনীতে পরিবর্তন আসেনি। অনেক জায়গায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই পরিবর্তন ছাড়া খুব একটা আগানো যাবে না।
গত ৪ আগস্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এতে রাষ্ট্র ও সরকারের এক বছরের চিত্র উঠে আসে। টিআইবি বলেছে, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের পর এক বছরে বিচার, সংস্কার, নির্বাচন প্রস্তুতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে সুশাসনের আলোকে অপ্রাপ্তি বিশেষ করে একদিকে আইনের শাসন ও স্বচ্ছতার ঘাটতি, স্বার্থের দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের একাংশের দলবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, মামলা-বাণিজ্য, গ্রেফতার ও জামিন বাণিজ্যের চাপে রাষ্ট্রসংস্কারের অভীষ্ট অর্জনের পথ কণ্টকাকীর্ণ হচ্ছে।
অবশ্য সরকারের বছরপূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ১২টি সফলতার কথা তুলে ধরেছেন। সেগুলো হচ্ছে-শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা; অর্থনীতি পুনরুদ্ধার; বাণিজ্য ও বিনিয়োগে অগ্রগতি; গণতান্ত্রিক সংস্কার ও জুলাই সনদ; জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচার; নির্বাচন পরিকল্পনা ও সংস্কার; প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত সংস্কার; সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ইন্টারনেট অধিকার; পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন; প্রবাসী ও শ্রমিক অধিকার; শহীদ ও আহত বিপ্লবীদের সহায়তা এবং সামুদ্রিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
শফিকুল আলম বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরেছে, যার ফলে নৈরাজ্য ও প্রতিশোধের চক্র বন্ধ হয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বড় ভূমিকা রেখেছে এই সরকার। খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশ থেকে অর্ধেকে নামানো হয়েছে। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৮.৪৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে (যা ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন)। বহু বছর পর টাকার মান ডলারের বিপরীতে বেড়েছে এবং ব্যাংক খাত স্থিতিশীল হয়েছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনা হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, দুর্বল সরকার এটি পারবে না। কিন্তু এই সরকার সেটি করে দেখিয়েছে।
কালের আলো/এইচএন/এমএএইচ