ফ্যাসিবাদের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হার না মানা জামায়াত আমির

প্রকাশিতঃ 6:08 pm | July 19, 2025

মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো:

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনীতিতে ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। অতীতে কখনও এই দলটি রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে পারেনি। রাজনীতির প্রয়োজনে বিএনপির সঙ্গে যৌথভাবে অবশ্য কিছু সমাবেশে করেছিল সোহরাওয়ার্দীতে। দলটির একক সমাবেশ ছিল কেবলই বায়তুল মোকাররম, পল্টন ময়দানসহ বিভিন্ন জায়গায়। এবারই প্রথম শনিবার (১৯ জুলাই) ‘সাত দফা’ দাবিতে এককভাবে জাতীয় সমাবেশ করলো দলটি। ইতিহাসে প্রথমবার এই সমাবেশের মাধ্যমে রাজনীতিতে রীতিমতো নতুন ইতিহাস তৈরি করলো তাঁরা। জানান দিলো নিজেদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। কর্মী-সমর্থকদের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে বহি:প্রকাশ ঘটালো নিজেদের সাংগঠনিক শক্তিমত্তার। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো তো বটেই এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারও জামায়াতের এই জাতীয় সমাবেশের মাধ্যমে একটি নতুন বার্তা পেয়েছে। জাতীয় সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন- ‘পুরোনো ব্যবস্থাপত্রে বাংলাদেশ আর চলবে না।’ অমিত দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি উচ্চারণ করলেন-‘আগামীর বাংলাদেশে আরেকটা লড়াই হবে, ইনশাআল্লাহ। একটা লড়াই হয়েছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, আরেকটা লড়াই হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইনশাআল্লাহ। এই দুর্নীতির মূলোৎপাটন করার জন্য যা দরকার, আমরা তারুণ্য এবং যৌবনের শক্তিকে একত্রিত করে সেই লড়াইয়েও জিতব ইনশাআল্লাহ।’

আমিরে জামায়াত যে লড়াইয়ের ঘোষণা দিলেন তিনি যে সেই লড়াইয়ের অগ্রভাগেই থাকবেন এবং তাঁর দৃঢ় মনোবল ও অসীম সাহস রয়েছে সেই প্রমাণও মিলেছে স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ এই সমাবেশে। জাতীয় সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়েই মঞ্চে লুটিয়ে পড়েছিলেন তিনি। বিকেল ৫টা ২২ মিনিটের দিকে তিনি বুকে হাত দিয়ে প্রথম দফায় মঞ্চে লুটিয়ে পড়েন। দু:সহ গরমে বক্তব্য দিতে গিয়ে মোট দুই দফায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে পাশে থাকা নেতাকর্মীরা তাকে ঘিরে ফেলেন। এর মিনিট খানেক বাদে জামায়াত আমির উঠে দাঁড়ান এবং আবার বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। কিন্তু আবারও পড়ে যান তিনি। এ সময় দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘গরমের জন্য আমিরে জামায়াত সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, তার আর বক্তব্য দেওয়া ঠিক হবে না।’ কিন্তু যার সাহস অতুলনীয়, দেশপ্রেম যার অস্থিমজ্জায় গ্রোথিত তিনি কী আর বিচলিত হতে পারেন? কারও কথা না শোনে মঞ্চে ডায়াসের পাশে পা মেলে বসে বক্তব্য দিলেন তিনি। এসময় তার পাশে চিকিৎসকদেরও দেখা গেছে। বসে বসেই প্রায় ১০ মিনিট বক্তব্য দেন জামায়াতের আমির। তার বক্তব্যের মধ্য দিয়েই শেষ হয় দলটির ‘জাতীয় সমাবেশ’। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে রাজধানীতে জামায়াতের স্মরণকালের বিশাল এই জনসমুদ্র আদতে দেশের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। আমিরে জামায়াতের স্বপ্নপূরণের লড়াইয়ের দৃঢ়তা দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলার শক্তি-সাহসে করবে আরও দুর্বার এমনটিই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন রাজধানীতে বড় বড় সমাবেশ করেছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ওলামা-মাশায়েখ বাংলাদেশ এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ বিভিন্ন ইস্যুতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করেছে। বিএনপি নয়াপল্টনে কয়েক দফা সমাবেশ করলেও জামায়াতে ইসলামী কেবল কারাবন্দি নেতা (বর্তমানে মুক্ত) এ টি এম আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবিতে পুরানা পল্টন মোড়ে একটি সমাবেশ করেছিল। তবে এবারই প্রথম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ইসলামী দলগুলো ও অন্যান্য সমমনা দলগুলোর ঐক্যকে আরও সুসংহত করতে এবং ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জন করতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনতার অভূতপূর্ব এক জাগরণ ঘটিয়ে ভোটের মাঠে প্রকৃত ফ্যাক্টর হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করলো। পাল্টে দিলো রাজনীতির হিসাব-নিকাশ।

জাতীয় সমাবেশে বক্তৃতার সময় হঠাৎ অসুস্থ হওয়ার পর জামায়াত আমিরকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর রাত ৯টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতাল থেকে হেঁটে বের হন তিনি। হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘জাতির জন্য মনের কথাগুলো আল্লাহর ইচ্ছায় পুরো বলতে পারিনি। যারা আমার অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন হয়েছেন ও দোয়া করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি সবসময় চেয়েছি- আমার দ্বারা যেন এই দেশ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশ থেকে ফ্যাসিবাদ বিদায় নিয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এখন সময়ের দাবি। এটি শুধু জামায়াত নয়, সব রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন। কারণ, দেশ যদি দুর্নীতিমুক্ত না হয়, তাহলে কোনো কিছুই সঠিকভাবে এগোবে না।’

নতুন ব্যবস্থায় নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার ডাক


জামায়াতের জাতীয় সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, ‘যাদের ত্যাগ এবং কুরবানির বিনিময়ে, স্বৈরাচারের কঠিন অন্ধকার যুগের যাঁতাতলে পিষ্ঠ হয়ে যারা তিলে তিলে দুনিয়া থেকে নির্যাতিত হয়ে বিদায় নিয়েছেন, অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিদায় নিয়েছেন, যারা লড়াই করে আহত হয়েছেন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন; আমরা তাদের সবার কাছে গভীরভাবে ঋণী। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, আল্লাহ যেন তাদের ঋণ পরিশোধ করার শক্তিটাও ততদিন আমাদের দান করেন।’

‘শহীদ আবু সাঈদরা যদি বুক পেতে না দাঁড়াতো, এ জাতির মুক্তির জন্য যদি বুকে গুলি লুফে না নিত, হয়তো আজকের এই বাংলাদেশটা আমরা দেখতাম না। ইতোমধ্যে হয়তো আরও অনেক মানুষের জীবন ফ্যাসিবাদীদের হাতে চলে যেত। ২৪-এ জীবনবাজি রেখে যুদ্ধটা যদি না হতো তাহলে আজকে যারা বিভিন্ন ধরনের কথা এবং দাবি-দাওয়া পেশ করছেন, তারা তখন কোথায় থাকতেন?’

জামায়াতের আমির বলেন, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালার এই নেয়ামত পাওয়া তাদের যেন অবজ্ঞা এবং অবহেলা না করি। শিশু বলে তাদের যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করি। অহংকারে অন্য দলকে যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করি। অরাজনৈতিক ভাষায় আমরা যেন কথা না বলি। যদি এগুলো আমরা পরিহার করতে না পারি, তাহলে বুঝতে হবে যারা পারবেন, ফ্যাসিবাদের রোগ তাদের মধ্যে নতুন করে বাসা বেঁধেছে। রাজনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষা করে জাতীয় ঐক্যের বীজতলাটা আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে তৈরি করবো ইনশাআল্লাহ।

ডায়াসের পাশে বসে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আল্লাহ যত সময় হায়াত দিয়েছেন, তত সময় মানুষের জন্য লড়াই করবো ইনশাআল্লাহ। এ লড়াই বন্ধ হবে না। বাংলার মানুষের মুক্তি অর্জন হওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে। বলছিলাম, জামায়াতে ইসলামী যদি আল্লাহর ইচ্ছা এবং জনগণের ভালোবাসায়, বাংলাদেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পায়, তাহলে মালিক হবে না, সেবক হবে ইনশাআল্লাহ।’

‘লক্ষ জনতাকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যদি নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে, তাহলে কোনো এমপি, কোনো মন্ত্রী আগামীতে সরকারি প্লট গ্রহণ করবে না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী ট্যাক্সবিহীন কোনো গাড়ি চড়বে না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী তার নিজের হাতে কোনো টাকা চালাচালি করবে না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী যদি তার নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ১৮ কোটি মানুষের সামনে তারা তার প্রতিবেদন তুলে ধরতে বাধ্য হবেন’- যোগ করেন তিনি।

আমিরে জামায়াত বলেন, ‘চাঁদা আমরা নেব না, দুর্নীতি আমরা করবো না। চাঁদা আমরা নিতে দেব না, দুর্নীতি আমরা সহ্য করবো না। আজীবন সবার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছি, জেল-জুলুমের পরোয়া করি নাই। আমার আফসোস, ২৪ সালে জাতিকে মুক্তি দিতে গিয়ে যারা জীবন দিয়ে শহীদ হলো-আমি তাদের একজন হতে পারলাম না। আপনাদের কাছে দোয়া চাই, ইনসাফের ভিত্তিতে একটি দেশ গড়ে তোলার জন্য আগামীতে যে লড়াই হবে, আমার আল্লাহ যেন সেই লড়াইয়ে আমাকে একজন শহীদ হিসেবে কবুল করেন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রিয় শহীদ নেতৃবৃন্দ, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে, শাপলা গণহত্যা, সারাদেশের গণহত্যা, চব্বিশের গণহত্যা যারা করেছে, তাদের সবার বিচার বাংলাদেশের মাটিতে নিশ্চিত করতে হবে। এদের বিচারের দৃশ্যমান প্রক্রিয়া শুরু না করা পর্যন্ত পুরানো ব্যবস্থাপত্রে বাংলাদেশ আর চলবে না।’

জামায়াত আমির আরও বলেন, ‘এতগুলা মানুষ এমনি এমনি জীবন দেয়নি। জীবন দিয়েছে জাতির মুক্তির জন্য। যদি পুরোনো সবকিছুই টিকে থাকবে, তাহলে কেন তারা জীবন দিয়েছিল? যারা ওই বস্তাপঁচা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশকে আবার নিতে চান, তাদের আমরা বলি, জুলাইযুদ্ধ করে যারা জীবন দিয়েছে আগে তাদের জীবনটা ফেরত এনে দেন। যদি শক্তি থাকে ফেরত এনে দেন। আপনারা পারবেন না। যেহেতু পারবেন না, কাজেই নতুন ব্যবস্থায় নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে ইনশাআল্লাহ।’

জাতীয় সমাবেশ যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও উত্তরের সেক্রেটারি রেজাউল করিম। সমাবেশে অন্যান্য দলের নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনূস আহমদ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) মুখপাত্র রাশেদ প্রধান, জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, গণ আন্দোলনের সময় রংপুরে নিহত আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী, নেজামে ইসলামী পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ, রফিকুল ইসলাম খান। জামায়াত নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য এ টি এম আজহারুল ইসলাম, নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, ঢাকা মহনগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন প্রমুখ।

কালের আলো/এমএসএএকে/এমকে