মবের বিরুদ্ধে সোচ্চার সেনাবাহিনী, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ
প্রকাশিতঃ 6:34 pm | July 03, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর অস্থিতিশীল পরিবেশে বিভিন্ন গোষ্ঠী আইন হাতে তুলে নেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঢিলেঢালা ভাব ও নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে মব সৃষ্টি হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে, সরকার মব ভায়োলেন্স সমর্থন করে না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, মব ভায়োলেন্স বন্ধ করতে হবে।
মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও। বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেস এ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সেনাসদরের মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের (স্টাফ কর্নেল) কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম উদাহরণ টেনে জানান, পটিয়ার ঘটনায় সেনাবাহিনী তড়িৎগতিতে ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং কক্সবাজার-চট্রগ্রাম মহাসড়কে যখন অবরোধ ছিল; সেনাবাহিনী গিয়েই সে অবরোধ মুক্ত করে। সাবেক সিইসি এ কে এম নূরুল হুদা যখন মব ভায়োলেন্সের শিকার হন তার পাশেই পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। মব ভায়োলেন্সের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী সোচ্চার রয়েছে। তিনি সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা ও দুর্ভোগ লাঘবে সেনাবাহিনী সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও জানান।
সংবাদ সম্মেলনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন তিনি। থানা থেকে যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ অস্ত্র নির্বাচনের আগেই উদ্ধার হবে বলেও জানিয়েছেন কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম। নির্দেশনা পেলে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে সেনাবাহিনী, এমনটিও জানান তিনি।
মব ভায়োলেন্স কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে সেনাবাহিনী
ঢাকার মতো একটি জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে মব সৃষ্টির বিষয়ে সেনাবাহিনীর বক্তব্য কী- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলতে পারি ওই ঘটনার (মব সৃষ্টি করে নূরুল হুদাকে লাঞ্ছিত) পরে যে ছয়জনকে চিহ্নিত করা গেছে তার মধ্যে একজনকে পরের দিনই গ্রেফতার করেছি। আইনি প্রক্রিয়ার জন্য আদালতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে কেউ যদি জামিন পেয়ে থাকে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু করার নেই।
তবে মব ভায়োলেন্স কিংবা জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী যেকোনো ঘটনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সোচ্চার ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে বলে জানান এই সেনা কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, গত ২২ জুন উত্তরায় নিজ বাসভবনে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা মব ভায়োলেন্সের শিকার হন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ২২ জুন ঘটনার পর সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মব ভায়োলেন্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতারের চেষ্টা শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় র্যাব ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় সেনাবাহিনী গত ২৩ জুন উত্তরা থেকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত মো. হানিফকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু ২৫ জুন ঘটনার মূলহোতা মোজাম্মেল হক ঢালী আদালত থেকে অগ্রিম জামিন লাভ করেন।
গত ২৬ জুন কুমিল্লার মুরাদনগরের একটি গ্রামে সংঘটিত নারী নির্যাতন ও বর্বরতার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে। মূল আসামি ফজর আলী ও আরও চারজন ভিডিও ধারণকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ভুক্তভোগী পরিবারের সুরক্ষা ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় পূর্ণ সহযোগিতা করছে।
কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, দেশের জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও স্থাপনার নিরাপত্তা প্রদানসহ সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সম্মানিত সেনাবাহিনী প্রধানের দিকনির্দেশনাকে অনুসরণ করে সেনাসদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, গণমাধ্যম এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সার্বক্ষণিক সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ভবিষ্যতে দিনগুলোতে জানমালের ক্ষতিসাধন, মব ভায়োলেন্স এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারে এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নেবে।
লুট হওয়া ৮০ শতাংশ অস্ত্র উদ্ধার, নির্বাচনের আগে বাকিগুলো
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের একাধিক থানাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ অস্ত্র নির্বাচনের আগেই উদ্ধার হবে বলে জানিয়েছে সেনা সদরদপ্তর।
বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এমন তথ্য জানান সেনাসদরের মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের (স্টাফ কর্নেল) কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম।
দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলাকে সেনাবাহিনী কীভাবে মূল্যায়ন করবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আগের তুলনায় অনেক ভালো। সারাদেশে সেনাবাহিনীর যে হটলাইন নম্বর আছে সেগুলো নম্বরে কোনো ধরনের অভিযোগ আসে এবং কীভাবে সমাধান করা হয় এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অধিকাংশ জমিজমা ও টাকা-পয়সা সংক্রান্ত অভিযোগ আসে। সব ধরনের অভিযোগ নেওয়ার পর যাচাই-বাছাই করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
গুমের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ পেলে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা
গুমের অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর সদস্যরা অনেকেই বিভিন্ন সংস্থায় ডেপুটেশনে থাকে। এ সংস্থাগুলো সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। ডেপুটেশনে থাকা কিছু কিছু সেনাসদস্যদের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ এসেছে এবং তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্তে যদি গুমের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ পায় তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ সংক্রান্ত সেনাবাহিনী সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। জাতিসংঘের সহায়তায় একটি মানবাধিকার বিষয়ক অফিস বাংলাদেশে খোলার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি একটি রাষ্ট্রীয় বিষয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করি।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ভুক্তভোগী পরিবার যদি নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সেনাবাহিনীর কাছে সহযোগিতা চান তাদের যথাযথভাবে সহযোগিতা করা হবে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত সেনাবাহিনী, ৪০০ কিশোর গ্যাং সদস্য গ্রেপ্তার
নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে সেনাবাহিনী এখনো কোনো নির্দেশনা পায়নি। পেলে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে সেনাবাহিনী।
কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত সম্পর্কে করা আরেক প্রশ্নের জবাবে সেনা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত ৪০০ জনের বেশি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। সেনাবাহিনীর পক্ষে অলিতে-গলিতে থাকা সম্ভব না। তবে তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী দ্রুত গিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গত দুই সপ্তাহে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৫৬২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য, তালিকাভুক্ত অপরাধী, ডাকাতসহ অন্যান্য অপরাধী রয়েছেন। এই পর্যন্ত সেনাবাহিনী ১৫ হাজার ৬৪৬ জন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে সেনাসদরের মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের (স্টাফ কর্নেল) কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার অভিযানে গত দুই সপ্তাহে সেনাবাহিনী ৫৬টি অবৈধ অস্ত্র ও ৯৯০ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। এ সময়ে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৫৬২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ১৫ হাজার ৬৪৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী।
তিনি বলেন, চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রেফতার ও অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার অভিযানে গত দুই সপ্তাহে সেনাবাহিনী ২৬টি অবৈধ অস্ত্র ও ১০০ রাউন্ড গোলাবারুদ এবং আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মোট ৯ হাজার ৬৯২টি অবৈধ অস্ত্র ও ২ লাখ ৮৬ হাজার ৮৫৪ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে।
কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, সেনাবাহিনী গত ২১ জুন খুলনা জেলার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী বুলবুলকে তার চারজন সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করে। অভিযানে ১টি অত্যাধুনিক বিদেশি পিস্তল, ১টি দেশীয় পিস্তল, ১টি শটগান এবং ২ রাউন্ড অ্যামোনিশন উদ্ধার করা হয়। সন্ত্রাসী বুলবুল ‘বুলবুল গ্রুপ’ নামে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের নেতা।
গত ২৯ থেকে ৩০ জুন মীর হাজিরবাগ আল আমীন সন্ত্রাসী গ্রুপের দুজন সক্রিয় সদস্য আনিছ ও হাসানকে গ্রেফতার করা হয়। এ অভিযানে ৩টি বিদেশি পিস্তল, ১টি বিদেশি রিভলভার, ৩টি ম্যাগাজিন ও ১১ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
কর্নেল শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে গত দুই সপ্তাহে ৪৫ জন মাদক ব্যবসায়ী এবং আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৫ হাজার ৫২১ জনকে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। গত দুই সপ্তাহে সেনাবাহিনী মাদকের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে সফল অভিযান পরিচালনা করে। এছাড়াও গত ১৭ জুন টঙ্গি মাজার বস্তি এলাকায় একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে মাদক ব্যবসা ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ২৪ জন ও গত ২৬ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অভিযান পরিচালনা করে ৪০ জনকে গ্রফতার করা হয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ ধরনের অভিযান চলমান থাকবে।
কালের আলো/এমএএএমকে