অর্থে দুর্গতি রাজস্বে লাল বার্তা
প্রকাশিতঃ 12:32 pm | July 02, 2025

মোস্তফা কামাল:
ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় রকমের সর্বনাশ করে কাজে ফিরেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একমাসেরও বেশি সময় ধরে এনবিআরের সংস্কার প্রতিরোধ এবং চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে ট্রেড ইউনিয়ন স্টাইলে আন্দোলন করছেন প্রতিষ্ঠানটির একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী। বছরের যে সময়টায় (মে-জুন) তাদের কাজ সবচেয়ে বেশি তখনই তারা থেকেছেন কর্মহীন। বাজেট ঘোষণার পূর্বাপরের এ সময়টা বেছে নিয়ে তারা অর্থ সেক্টরে যে ক্ষতি করেছেন তা অপূরণীয়। সর্বশেষ পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা গত শনিবার থেকে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন শুরু করলে দেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানিসহ সার্বিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দেয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে রোববার সব কাস্টমস হাউজ, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক স্টেশনসমূহের সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস ঘোষণা করে বিবৃতি দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। একই সাথে এই আন্দোলন পরিকল্পিত ও দুরভিসন্ধিমূলক এবং জাতীয় স্বার্থ ও নাগরিক অধিকারের পরিপন্থি বলে উল্লেখ করে সরকার। আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনতিবিলম্বে কাজে যোগ না দিলে কঠোর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। রোববারও কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে দিনভর দফায় দফায় বৈঠক করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। রাতে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা। এর মধ্য দিয়ে আমদানি-রপ্তানিতে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার অবসান কিন্তু হলো না। এর জের ও ছাপ সইতে হবে গোটা অর্থনীতিকে।
আন্দোলনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘ্নিত হয়েছে উল্লেখ করে আগামীর রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। বলেন, আন্দোলনের জেরে রাজস্ব আদায় কম হবে। তা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন বলেও জানান তিনি। বন্দরগুলোতে যে পরিস্থিতি চলছে, তা কীভাবে সামলানো হবে, ভাবনায়ও আসছে না সংশ্লিষ্টদের। অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি খাতের তলানি দশার সরাসরি ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা। অন্যদেরও তা বোধগম্য।
এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের বিশেষ আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা হচ্ছে তাদের রাজনীতিমুক্ত রাখা। নিশ্চিন্তে ব্যবসায় মনোযোগী থাকতে দেওয়া। সেইসঙ্গে গুরুতর অভিযোগে জড়িত থাকলে তাদের বিচার নিশ্চিত অবশ্যই করতে হবে। তা ব্যবসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা উৎপাদনের চাকা বন্ধ করে নয়। ব্যাপক বিনিয়োগ, গতিময় ব্যবসা, চাঙ্গা পুঁজিবাজার, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধিসহ সম্ভাবনার দরজা-জানালা খোলা রাখা সরকারকে মোটাদাগে বাজেট সহায়তাও দিতে পারে। তখন বাজেট সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবির কাছে এত ধরনা দিতে হবে না। সরকার সেই চেষ্টা করছে না, ঘটনা এমন নয়।
সরকারের চেষ্টা-তৎপরতায় কোনো কমতি-ঘাটতি নেই। কিন্তু, রাষ্ট্রের অর্থনীতির মেরুদণ্ড পুঁজিবাজারকে বেহালে রেখে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের অবিরাম দূরে ঠেলে বদনামে ডুবিয়ে রেখে সেই চেষ্টায় সাফল্য আশা করা কতটা ফলদায়ক, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ গত দশ মাসের বাংলাদেশ। চারদিকে নতুন করে সমানে বায়নানামা। দাবির মহোৎসব। এদের মধ্যে যারা বড় বড় অফিসে কলম চালায়, ক্ষমতাধর-তাদের দাবিগুলো পূরণ হয়ে যাচ্ছে তুলনামূলক সহজেই। বাকিরা রাস্তায় লাঠিপেটা খাচ্ছে।
ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা না পারছেন রাস্তায় নামতে বা কলম বিরতি করতে। না পারছেন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে। এ অবস্থার মাঝে বিদেশি বিনিয়োগের রাজকীয় আয়োজনে অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা জাগিয়ে এখন উল্টা খবর। একদিকে, বিদেশি বিনিয়োগের বন্যা বইয়ে দেওয়ার ঢেকুর, অন্যদিকে দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগই কেবল অতলমুখী। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের সূচক হিসেবে বিডায় নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রস্তাবের সংখ্যা নিম্নমুখী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের নিট প্রবাহেও খরার টান।
শিল্পের মূলধনী যন্ত্র আমদানিও নিম্নমুখী। সরকারের বিভিন্ন দফতরের চেয়ে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য সাবুদ আরও বেশি। নিজ গরজেই তা জোগাড় রাখেন তারা। দেশি আর বিদেশি সব বিনিয়োগকারীই উচ্চ সুদ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন ব্যয়, রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মাপেন একই পাল্লায়। লগ্নি করা বিনিয়োগের গ্যারান্টি উভয়েরই কাম্য। সেই ভরসার জাগতিক জায়গা ফাঁপা রেখে বিনিয়োগ দূরে থাক, যা আছে তা রক্ষাই কঠিন।
ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা না পারছেন রাস্তায় নামতে বা কলম বিরতি করতে। না পারছেন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে। এ অবস্থার মাঝে বিদেশি বিনিয়োগের রাজকীয় আয়োজনে অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা জাগিয়ে এখন উল্টা খবর। একদিকে, বিদেশি বিনিয়োগের বন্যা বইয়ে দেওয়ার ঢেকুর, অন্যদিকে দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগই কেবল অতলমুখী। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের সূচক হিসেবে বিডায় নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রস্তাবের সংখ্যা নিম্নমুখী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের নিট প্রবাহেও খরার টান।
স্বাভাবিকভাবেই এতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কার্যকর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করা এবং বিনিয়োগ সুরক্ষা না থাকায় বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে। অনেকে জমিতে বিনিয়োগ করেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেউ চাইলেও তার বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত নিতে পারছে না। দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে প্রণোদনার চেয়ে পদে পদে বাধা দূর করা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতের দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। সেখানে এনবিআরের আন্দোলন প্রতিষ্ঠানটির চার দেওয়ালের মাঝে থাকেনি। এর তেজ-তাপ কেবল দেশ নয়, বিদেশি মহলও দেখেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও তা পর্যবেক্ষণ করেছে। এনবিআর সংস্কারকে ঘিরে কর্মকর্তাদের আন্দোলন এবং সার্বিক রাজস্ব সংস্কার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছেন আইএমএফের মিশনপ্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও। বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তথ্যটি জানান তিনি। ডেপুটি মিশনপ্রধান আইভো ক্রিজনার এবং বাংলাদেশে আইএমএফের আবাসিক প্রতিনিধি জয়েন্দু দে সংবাদ সম্মেলনে সংযুক্ত ছিলেন। রাজস্ব নীতি এবং ব্যবস্থাপনা আলাদা করতে আইএমএফের পরামর্শ রয়েছে। এ অবস্থায় আইএমএফের দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে আইএমএফ মিশনপ্রধানও কিছুটা লাল বার্তাই দিলেন।
বাংলাদেশের জন্য এখনকার সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থনীতির অনেক চ্যালেঞ্জের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। আর এর মাঝেই শুরু হয়েছে নতুন অর্থ বছর। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেট শেখ হাসিনা সরকার দিলেও এর প্রায় পুরোটা বাস্তবায়ন করল ইউনূস সরকার। নতুন বাজেটও তাদের দিতে হলো। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়নে গঠিত টাস্কফোর্স ও কমিটি তাদের প্রতিবেদনেও তা এসেছে। মানে সরকারের জানার বাইরে কিছু নয়। আবার অর্থনীতি তেমন না জানা মানুষও অর্থের লাল-সবুজ আলামত বোঝে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।