আন্দোলন সংগ্রাম ডাকসুর ভূমিকা
প্রকাশিতঃ 7:05 pm | March 08, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ধাপে ধাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন ডাকসুর সাবেক নেতৃবৃন্দ।
তারা মনে করেন, ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত, আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এবং পূর্ব বাংলার মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠায় ডাকসুর নেতৃবৃন্দের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
এছাড়াও ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ অত:পর স্বাধীন বাংলাদেশের নানা আন্দোলনে ডাকসুর নেতৃবৃন্দ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে বলে মনে করেন এই নেতারা।
১৯৬৬, ৬৭ ও ৬৮ সালে ডাকসুর প্রথম মহিলা ভিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যখন ডাকসুর ভিপি ছিলাম তখন ছিল রাজনীতির উত্তাল সময়। বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা হয়। আমরা সে সনদ দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলাম। শুধু তাই দেশ্যবাপী সচেনতন জনতাকে উজ্জীবিত করতে সেই দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কাচা রাস্তা পেরিয়ে ৬ দফার মাহাত্ব্য ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। এরপর হয় গণঅভ্যুত্থান। সেখানেও ডাকসুর নেতাকর্মীরা কী অপার শক্তি নিয়ে যে আন্দোলন করে তা বলে বোঝানোর মতো নয়। কতটুকু দেশপ্রেম থাকলে জীবন বাজি রেখে মানুষের অধিকারে আন্দোলন করা যায় তার নজির আছে ডাকসুর পরতে পরতে।
১৯৬৩-৬৪ সালে ডাকসুর ভিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রাশেদ খান মেনন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি ষাটের দশকের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা কাজ করি। এর আগেও শিক্ষা আন্দোলন পরে ৬ দফা থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পথে প্রতিটি আন্দোলনে আমরা অংশ নেই এবং সফল হই।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক হিসেবে খ্যাত ১৯৬৮-৬৯ মেয়াদে ডাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) তোফায়েল আহমেদ আজকের রাজনীতির অন্যতম উজ্জ্বল এক তারকা। তিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। ৭৬ বছর বয়সী বর্ষীয়ান এই নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগসহ মহাজোট সরকারের গত মেয়াদে (২০১৪-১৮) বাণিজ্যমন্ত্রী ছাড়াও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের জন্য গঠিত সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী এবং ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। সদ্যসমাপ্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ মোট সাতবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এর আগে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ সদস্যও (এমএনএ) নির্বাচিত হন।
তোফায়েল আহমেদ ১৯৬৬-৬৭ মেয়াদে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুললে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রেখেছিল তাকে।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিসহ ছয় দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফা দাবিতে পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানবিরোধী গণজাগরণ ও ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠলে তোফায়েল আহমেদ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। সেই ছাত্র ও গণআন্দোলনই ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। যার ফলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তোফায়েল ‘মুজিব বাহিনীর’ অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত চার প্রধানের একজন ছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সচিবের দায়িত্ব পালন করেন স্বৈরশাসনবিরোধী গণঅভ্যুত্থানসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
এ বিষয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি আ স ম আবদুর রব বলেন, আমার রাজনৈতিক জীবনে বিরাট উত্থানের কাল ছিল ১৯৭০। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন। প্রথমবারের মতো ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যক্ষ ভোটে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগের প্যানেলে আমি ভিপি পদে এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখন জিএস পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমরা জয়লাভ করি। এই বিজয় ছিল ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থীদের বিজয়।
তিনি বলেন, ডাকসুতে আমাদের জয়লাভের মধ্য দিয়ে দেশের ছাত্ররাজনীতি নতুন আঙ্গিক লাভ করে। ডাকসু হয়ে ওঠে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র। ১৯৭০-এর ডাকসু নির্বাচনে জয়লাভ আমাদেরই নয়, সমগ্র জাতির জীবনেরও একটি স্মরণীয় ঘটনা।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, বাঙালি জাতির পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বহু সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় তৃতীয় জাগরণের আরেক ধাপ ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। স্কুলছাত্র থাকাকালেই ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মিছিল করতে গিয়ে কারাবরণ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা করা হলে বঙ্গবন্ধুর হত্যা বিচারের দাবীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি মিটিং মিছিল করেন।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের সময়ে আমরা কোনো কম্প্রাইজ করিনি। আমি মনে করি এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করছে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম আছে। দেশের জন্য কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় আছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা সেকাজটি করতে দিচ্ছে না। পাকিস্তান আমলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শামরিক সরকারের দখলের বাইরে ছিল কিন্তু আজ ক্ষমতাসীনরা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে একক আধিপত্য বিরাজ করছে।
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মেদ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৮৯-৯০ মেয়াদে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এই নেতা নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
ডাকসুর ইতিহাসের সর্বশেষ নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্রদল নেতা আমান উল্লাহ আমান। ১৯৯০ সালের ৬ জুন ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমানসহ ডাকসুর নির্বাচিত সর্বশেষ নেতা ও সেসময়কার ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বেই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন এবং দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়।
এছাড়াও সকল স্বাধিকার আন্দোলনে ডাকসুর নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
কালের আলো/এসআই/এমএইচএ