আর সেই মেয়েটি মারা গেল, আমি প্রধান শিক্ষক কিছুই করতে পারিনি…
প্রকাশিতঃ 9:15 pm | December 08, 2018

নাছিমা আক্তার :
যাহা বলেছিলাম…
গতবছর এর ঘটনা। ৭ম শ্রেনির এক শিক্ষার্থীর কাছে পাওয়া যায় বড়সড় এক এন্ড্রয়েট সেট। বাথ্রুমে গিয়ে কথা বলছিল মেয়েটি। অনেক্কখন শ্রেনিকক্ষে ফিরে না আসায় সন্দেহ হয় শিক্ষিকার। পরে ফোন সহ তাকে নিয়ে আসেন সহপ্রধান শিক্ষিকার নিকট। সহপ্রধান মেয়েটিকে মাকে আনতে বলেন। মেয়েটি অন্য এক মহিলাকে মা সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল কিন্তু মেডামদের জিজ্ঞাসাবাদে মহিলা বলে ফেলে সে ওই মেয়ের মা নয়। এর পর আসল মাকে ডাকা হয় , তিনি এলে মেডামগন আমার কাছে নিয়ে আসে। আমি মেডামদের ওই মেয়েকে নিয়ে বাইরে যেতে বলে শুধু মায়ের সাথে কথা বলি।
“মেয়ের মা তো কেঁদেই অস্থির। আমার মেয়ের কাছে ফোন! ওর বাবা জানলে হার্ট ফেল করবে।”
আমি বললাম, ওর বাবাকে অবশ্যই জানতে হবে এবং আপনাদের কারোই হার্ট এটাক বা স্ট্রোক করা যাবে না। মেয়েটি অনেক বেশি ছোট। কিছুই হয় নাই, মাত্র ভুলের শুরু। সবাই মিলে চেস্টা করলে সফল হবো , ইনশা আল্লাহ।
আর এও বললাম যে এখন বাসায় নিয়ে যান। বেশি জানা জানি হলে ভালো হবে না। কথা দিন বাসায় গিয়ে এইটা নিয়ে ওকে আপবারা কিছুই বলবেন না। সন্ধ্যায় বাসায় নিয়ে আসবেন । সাথে ওর বাবাকেও আনবেন।
সন্ধ্যায় তারা তিনজনেই এলেন। মেয়েটি বারবি ডলের মত পাতলা , ছোট্ট, সুন্দর। বাবার কলিজার টুকরা। বাবা লজ্জায় ,দুঃখ্ লাল হয়ে মুখ নিচু করে আছেন। মায়ের চোখে পানি।
আমি মেয়েটিকে শক্ত করে বুকের জড়িয়ে কিছুক্ষন ধরে রাখলাম। এটা আমার একটা টেকনিক। ব্যাখ্যাটা পরে দেব।
একটা সময় কানে কানে বললাম, “আমরা তো জেনেই গেছি যে, সেটটি আম্মু কিনে দেন নাই। আমাকে কী একটু বলবে কে কিনে দিয়েছে?
কিছুক্ষণ নিরব। জিজ্ঞেস করলাম কোন ছেলে ? মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
আমি বললাম তা বেশ। এখন আমাকে একটু ভেবে বলো তো , ছেলেটি সিনেমার নায়কের মত রিকশা চালিয়ে বা ইট ভেঙ্গে কিনে দিলো না কি বাবার পকেট বা মায়ের ভ্যেনেটি ব্যগ থেকে চুরি করে কিনে দিলো?
আমি বুকের সাথে ধরেই আছি।
কিছুক্ষন পর আস্তে করে বলল, চুরি ।
আমি বললাম আচ্ছা বেশ।
এখন কি আমাকে একটু বলবে, তোমার জীবনের লক্ষ্যটা কী ? সেটা যদি হয় কোন চোর এর বউ হবে, তবে আমার কিছুই বলার নেই। যে ছেলে আজ বাবা মায়ের টাকা চুরি করে সে কাল অন্য কারো টাকা চুরি করবে, রাস্তায় কারো পকেটে হাত দিয়ে ফেলবে। পুলিশে ধরবে । তাতো হতেই পারে তাই না?
বুঝলাম চিন্তায় পরে গেছে।
বললাম আচ্ছা অত ভাবাভাবির কি আছে চলো আজ রাতেই তোমাকে ওই ছেলের বাসায় দিয়ে আসি। ও তোমাকে এত দামি সেট দিতে পেরেছে। ও তোমার দায়িত্ব নিতে পারবে। খামোখা এই যে এত সুন্দর ভদ্রলোক মা বাবা, যারা তোমাকে এত্ত ভালোবাসেন তাদের আর কষ্ট করতে হবে না । চলো।
আর যদি তোমার মনে হয় বড় হবার ভালো কিছু করে দেখাবার স্বপ্ন তোমার আছে তাহলে আমরা সবাই তোমার পাশে সাহায্যকারি হিসেবে থাকব। একটু ভেবে বলো।
এইবার সেই আমাকে শকত করে ধরে বলল, না ! আমি আব্বু আম্মুর সাথেই আমাদের বাসায় যাবো। আর কোনদিন আব্বু আম্মু কষ্ট পায় এমন কিছু করব না।
এর পর মা বাবাকে বললাম আপনারা আমাকে কথা দিন এই ঘটনা নিয়ে ওকে আপনারা আর খুঁচা খুঁচি করবেন না।
মমতা ঢেলে দিবেন, মমতাপূর্ণ আচরণ করবেন, মমতাময় সময় দিবেন। Give your child Potential Time .
নাম্বার এর জন্য জিপিএ ৫ এর জন্য মাঝে মাঝে পিতা মাতার ও চাহিদার অন্ত থাকে না। আমার ক্লাশ ফোর এর বাচ্চারা আমাকে গত বছর পিতামাতার বিরুদ্ধে এক গাঁদা অভিযোগ করেছিল। ছ্যকা দেয়া, অপমান করে কথা বলার অভিযোগও ছিলো। ওদের কথা শুনে একে একে সব ক্লাশের অভিভাবক ডেকেছিলাম। বিষয়গুলো সম্পর্কে অনেক আলোচনা , দিক নির্দেশনা মুলক কথা বলেছিলাম।
আর সেই মেয়েটি ! যে কি না গতবার এর এস এস সি পরীক্ষার্থী ছিল, মায়ের বুকুনি খেয়েই মরে গেলো। আমি প্রধান শিক্ষক কিছুই করতে পারিনি কারণ…………।
বাচ্চাগুলোর অনেক রকম কষ্ট। ওদের কেউ বুঝতে চায় না। ওদের কষ্ট গুলো যখন আমাকে বলে তখনও কাঁদি , আর যেকষ্ট গুলো আমি মুছাতে পারি না তখনো আল্লাহর কাছে কাঁদি ।
আমাদের সমস্যার গভীরে যেতে হবে। সমাধানও আছে। কিন্তু কে শুনবে কথা???
চলবে…
লেখক: প্রধান শিক্ষক, বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া।