শোলাকিয়া জঙ্গি হামলায় পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট

প্রকাশিতঃ 10:03 pm | September 12, 2018

বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো:

কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলকিয়া ঈদগাহ ময়দানের প্রবেশপথে জঙ্গি হামলা মামলায় ৫ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।

বুধবার (১২ সেপ্টেম্বর) বিকালে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশের সম্মেলনকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ।

এ মামলায় ২৩ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে ১৮ জন নিহত হয়। বাকি পাঁচজন কারাগারে আটক রয়েছে। মামলার পাঁচ আসামিরা হলো কিশোরগঞ্জের জাহিদুল হক তানিম, গাইবান্ধা জেলার জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, চাপাইনবাবগঞ্জের মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, গাইবান্ধা জেলার মো. আনোয়ার হোসেন, কুষ্টিয়া জেলার সবুর খান হাসান।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৭ জালাই ঈদুল ফিতরের জামাতের আগে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের প্রবেশপথের আজিম উদ্দিন হাইস্কুলসংলগ্ন সবুজবাগ সংযোগ সড়কপথে জঙ্গি হামলার সময় পুলিশ ও জঙ্গি সংঘর্ষে গৃহবধূ ঝর্ণা রাণী ভৌমিক নিজ ঘরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

এছাড়া এ ঘটনায় জঙ্গিদের চাপাতির কোপে জহুরুল ও আনসারুল নামে দুই পুলিশ কনস্টেবল ও আবির রহমান নামে এক জঙ্গি নিহত হয় এবং ১০ পুলিশ সদস্য ও চার মুসল্লিসহ ১৪ জন গুরুতর আহত হয়।

ঘটনার পর পাশের আজিমউদ্দিন স্কুলের মাঠসংলগ্ন মুফতি মোহাম্মদ আলী মসজিদের সামনের টয়লেটে আত্মগোপনে থাকা হামলাকারী জঙ্গি দলের দলের সদস্য শফিউল ইসলাম ওরফে ডন ওরফে মোকাতিলকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে র‌্যাব। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় র‌্যাব পাহারায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। তাকে চিকিৎসা শেষে কিশোরগঞ্জ আনার পথে একই বছরের ৬ আগস্ট রাত ১১টার দিকে পার্শ্ববর্তী ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইলের ঘোষপাড়া ডাংরী নামক স্থানে একদল জঙ্গি অতর্কিত হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায়।

এ সময় র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় শফিউল ও মুস্তাকিম নামে দুজন। তারা শোলাকিয়া হামলার আসামি। এ সময় আহত হন র‌্যাবের তিন সদস্য।

র‌্যাব ও অন্যান্য একাধিক সূত্র জানায়, শোলাকিয়ার হামলাকারী শফিউল, আবির, করিমসহ কয়েকজন হামলার আগে ওই এলাকাটি কয়েক দফা পর্যবেক্ষণ করে। তাদের মূল পরিকল্পনা ছিল শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদকে হত্যা করা। কিন্তু পথে পুলিশের তল্লাশি তৎপরতা দেখে তারা বুঝতে পারে ঈদ জামাতের ভেতরে প্রবেশ করা সহজ হবে না। এ সময় হামলাকারী জঙ্গিদের কমান্ডার করিম সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ চেকপোস্টে হামলা করার।

এজন্য তারা সকাল সাড়ে ৮টার দিক আবির ও শফিউলের ব্যাগে থাকা গ্রেনেড বের করে। তারা একসঙ্গে ওয়ান, টু, থ্রি বলে গ্রেনেডের রিং খুলে ঈদগাহ ময়দানের প্রবেশ পথের পুলিশ চেকপোস্টের দিকে ছুড়ে মারে। একটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয় এবং অন্যটি অবিস্ফোরিত থেকে যায়। এ সময় আবির আরেকটি গ্রেনেড ছোড়ে। ওই গ্রেনেডের আঘাতে ঘটনাস্থলে দুই পুলিশ সদস্য পড়ে যান।

জঙ্গিরা তাদের প্যান্টের পকেটে বিশেষ কৌশলে লুকিয়ে রাখা চাপাতি বের করে দুই পুলিশকে কুপিয়ে জখম করে। পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকলে পিছু হটে জঙ্গিরা। এ সময় জঙ্গিরা তাদের প্যান্টের বাঁ পকেট থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।

পুলিশ ও র‌্যাব ঘটনাস্থলে হাজির হলে জঙ্গি শফিউল আরও একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে। তখন পুলিশ ও র‌্যাব গুলিবর্ষণ করতে থাকলে ঘটনাস্থলে শফিউলের বুকে গুলি লাগে। ওই সময় আবির চাপাতি উঁচিয়ে পুলিশকে কোপানোর চেষ্টা করে। পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যদের গুলিতে জঙ্গি আবির ঘটনাস্থলে মারা যায়।

গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে শফিউল জানিয়েছিলেন- আক্তার, পারভেজ, জাহিদ ও সে (শফিউল) একসঙ্গে এর আগে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে তরুণ দত্ত, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে গলা কেটে হত্যা, কুড়িগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন, গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জে হিন্দু ব্যবসায়ী দেবাশীষকে হত্যা করেছে।

শফিউলকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা তখন জানিয়েছিলেন শফিউলের সাংগঠনিক নাম আবু মোকাতিল। তার বাবা আবদুল হাই টেলিভিশন টেকনিশিয়ান। মায়ের নাম নারগিস সুলতানা। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর ঘোড়াঘাট থানার সিংড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ দেবিপুর গ্রামে। সে বিরামপুরের বিজুল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করার পর আলিমে পড়ছিল।

২০১৪ সালে শফিউলের চাচাতো ভাই শাহাবুদ্দিন তাকে গেরিলা আক্রমণের ব্যাপারে পরামর্শ দেয় এবং জেএমবির কর্মকাণ্ডে দীক্ষা দেয়। শাহাবুদ্দিন তাকে আবুল নামে অপর এক জেএমবি কর্মীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। আবুল পরে শফিউলকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় নিয়ে যায়।

১৫ জানুয়ারি শফিউল গাইবান্ধা গিয়ে ৪ মাস আবুলের বাসায় থাকে। সেখান থেকে সিরাজগঞ্জে গিয়ে জনৈক জেএমবি নেতা রাজিবের সঙ্গে পরিচিত হয়। রাজিব তাকে কিছু জিহাদি বই, একটি মোবাইল ফোন, কিছু জিহাদি লিফলেট দেয়। শফিউলকে দেয়া মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক আইসি খুলে রাখা ছিল। ওই মোবাইল থেকে বিভিন্ন ধরনের জিহাদি বক্তব্য শুনানো হতো।

রাজিব ৪ মাস পর শফিউলকে নিয়ে বগুড়া যায়। সেখানে একটি গ্রামের চর এলাকায় শফিউলকে হালকা ব্যায়াম শেখায় এবং লাঠি দিয়ে বন্দুকের বিভিন্ন লক্ষ্য দেখানো হয়। প্রশিক্ষণের সময় স্থানীয় অজ্ঞাতপরিচয় আরও সাত ব্যক্তি ছিল।

রাজিব গুলশান হামলার ৫ দিন আগে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের মধ্য থেকে ৫ জনকে নিয়ে যায়। তারা প্রশিক্ষণের সময় চারটি পিস্তল, একটি পয়েন্ট ২২ রাইফেল, দুটি ছুরি, একে-৪৭ রাইফেল, এসব অস্ত্রের ৫টি ম্যাগাজিন ও ৮০টি বুলেট ব্যবহার করে। গুলশান হামলার পরদিন ২ জুলাই শফিউলকে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় নিয়ে যায় রাজিব।

সেখানে বিকাশ নামে এক ব্যক্তির সহায়তায় কিশোরগঞ্জের নীলগঞ্জ সড়কের খানকা শরিফ সংলগ্ন একটি বাড়িতে ফ্ল্যাট ভাড়া করে। শফিউলসহ কয়েক জঙ্গি সেখানেই থাকত। ঘটনার দিন ৭ জুলাই সকালে শফিউল এবং আবির একটি গ্রুপে এবং আরও দুটি গ্রুপে ২ জন করে ৪ জন ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে বের হয়।

নীলগঞ্জ রোডের চার মাথার মোড় থেকে রিকশায় আজিমউদ্দিন স্কুলের মাঠের পশ্চিম দিকে নামে তারা। সেখানে তারা পুলিশের চেক পোস্ট দেখে থমকে দাঁড়ায়। কিছু সময় পর তাদের কমান্ডার করিম পুলিশের ওপর হামলার নির্দেশ দেয়।

কালের আলো/এমএইচ

Print Friendly, PDF & Email