প্রশাসনের নির্দেশনা উপেক্ষিত, বরিশালে ছুটির দিনেও চলছে কোচিং বাণিজ্য

প্রকাশিতঃ 12:42 am | August 11, 2018

বরিশাল সংবাদদাতা, কালের আলো:

শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে লেখাপড়ার নামে চাপিয়ে দেওয়া কোচিং বন্ধে জেলা প্রশাসনের আলোচিত উদ্যোগ ছিল শুক্র ও শনিবার কোচিং বন্ধ রাখা।

নির্দেশনা জারির কয়েক মাস সেই অনুসারে চললেও আবারও শুক্র ও শনিবার চালু হয়েছে কোচিং ক্লাস।

সাপ্তাহিক পরীক্ষা ও ‘এক্সট্রা কেয়ার’র নামে পুরোদমে শিক্ষার্থীদের শুক্র ও শনিবার কোচিংয়ে যেতে বাধ্য করেছে কোচিং পরিচালকরা। এতে করে একদিকে যেমন জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে তেমনি বাড়তি চাপ পরছে কোমলমতি শিশুদের ওপর।

এদিকে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোচিং ব্যবসার সাথে জড়িত থাকায় ‘কোচিং না করে উপায় নেই’ বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা।

আবার অনেক অভিভাবক বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা যথাযথ শিক্ষা না পাওয়ায় জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা থাকলেও তা মানতে পারছেন না তারা। ফলে কোচিং সেন্টারের দিকে ঝুঁকছেন তারা। নগরীর অলি-গলিতে চালু হওয়া খ্যাত-অখ্যাত কোচিং সেন্টারে ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

মূলত স্কুলের লেখাপড়ার চেয়ে বরিশালে কোচিং বাণিজ্য দীর্ঘদিন ধরেই জমজমাট অবস্থায় চলছে।

জানা গেছে, বিভিন্ন দিবস ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে স্কুল বন্ধ থাকলেও বন্ধ থাকে না কোচিং সেন্টার। এমনকি বেশির ভাগ অভিভাবকের বিদ্যালয়ের চেয়ে কোচিংয়ে আগ্রহ বেশি। মেধা বিকাশ ও শারীরিক সুস্থ্যতার জন্য বিকেলটা শিশুদের খেলাধুলার উপযুক্ত সময়। কিন্তু সে সময় কোচিংয়ে যাওয়ার কারণে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে।

এ অবস্থায় শিশুদের খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ দিতে সপ্তাহে দুদিন কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক মোঃ হাবিবুর রহমান। একই সাথে প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা পাঠিয়েছিলেন বরিশাল শিক্ষাবোর্ড।

চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে এই নির্দেশনা প্রদান করেন জেলা প্রশাসন ও শিক্ষা বোর্ড। বিষয়টিকে স্বাগত জানায় সুধী সমাজ। পাশাপাশি নির্দেশনা যেন কঠোরভাবে মানা হয় সেজন্য জেলা প্রশাসনও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কোচিং সেন্টারগুলোকে মনিটরিং করতে থাকে।

তবে নির্দেশনার ৬ মাসের ব্যবধানে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আবারও কোচিং সেন্টার চালু হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা।

শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এস.এম ইকবাল মনে করেন, কোমলমতি শিশুদের মেধা ধ্বংস করার জন্য পরীক্ষায় ভালো করার নামে কোচিং সেন্টারগুলো ব্যবসা করে আসছে। বর্তমান জেলা প্রশাসক এসব বন্ধ করে শিশুদেরকে আলোর পথে নিয়ে আসছিলেন। কিন্তু কোচিং সেন্টার পরিচালকরা যদি আবারও সেসব চালু করে থাকে তাহলে তা জাতির মেধা ধ্বংসের জন্য খুলেছে।

এসএম ইকবাল আরও বলেন, যেসব কোচিং সেন্টার শুক্র ও শনিবার নির্দেশনা অমান্য করে কোচিং চালু রাখছে তাদের কোচিং সেন্টার একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

শিশু সংগঠক শুভংকর চক্রবর্তী বলেন, পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে অনেক আয়োজন করে আমরা একটি বিষয় শুরু করে থাকি। কিন্তু তা আর শেষ পর্যন্ত সফল হয় না। এর পিছনে কাজ করে মনিটরিং না থাকা। জেলা প্রশাসন অত্যান্ত যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু মনিটরিংয়ের অভাবে তা হয়তো ভেস্তে যাচ্ছে। এভাবে কোচিং সেন্টারদের মাথাচড়া শিশুদের সৃজনশীল মেধা বিকাশ পুরোপুরি নষ্ট করে দিবে। শুভংকর চক্রবর্তী মনে করেন, জলো প্রশাসনের এখন উচিত কোচিং সেন্টারগুলোকে আবারও মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা।

সরেজমিনে বরিশাল বাংলা বাজারস্থ মর্ডান একাডেমি, বিএম কলেজ এলাকার সানফ্লাওয়ার কোচিং সেন্টার, বৈদ্যপাড়া রোডস্থ অর্নিবান ক্যাডেট কোচিং, বগুড়া রোডস্থ শাহীন শিক্ষা পরিবার, রুপাতলীতে সানরাইজ কোচিং হোম এবং শিক্ষণ একাডেমি কোচিং সেন্টার ঘুরে জানা গেছে, শুক্র বার ও শনিবার দুটি ইস্যুতে কোচিং চালু থাকে।

এরমধ্যে শুক্রবার সাপ্তাহিক পরীক্ষার অজুহাত এবং শনিবার ‘এক্সট্রা কেয়ার ক্লাশ নিয়ে থাকে। কথা হয় অর্নিবাণ ক্যাডেট কোচিং সেন্টারের এক শিক্ষার্থীর বাবা শিপলু’র সাথে।

তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন সপ্তাহে দুই দিনের কোচিং বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়ার পর ছেলে-মেয়েরা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। কোচিং সেন্টারের পরিচালক আবাসিক সিস্টেম চালু রাখায় ওই দুই দিনও সমান তালে ক্লাশ-পরীক্ষা চালু রাখছেন। ওই দুই দিন কোচিংয়ে না আসলে ‘প্রচুর মারধর করে’ বলে দাবী করেন এই অভিভাবক।

রুপাতলীর সানরাইজ কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী রুবাইয়া তাবাচ্ছুম মিথিলা বলেন, কোচিংয়ে না আসলে স্যাররা মন্দ কথা বলেন। নম্বর দেন না।

কথা হয় মর্ডান একাডেমী, সানফ্লাওয়ার ও শিক্ষণ কোচিং সেন্টারের কর্মচারীদের সাথে। তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি না হলেও জানিয়েছে, ফি নিয়ে শুক্র ও শনিবার শিক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা ক্লাশ নিয়ে থাকেন।

এ বিষয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক মো: হাবিবুর রহমান বলেন, আমি জানতে পেরেছি কিছু কিছু কোচিং সেন্টার নির্দেশনা মানছে না। আমরা তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, সিটি নির্বাচনের কারণে কোচিং সেন্টারগুলোতে জোরদার মনিটরিং সম্ভব হয়নি। এখন আবারও নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনে মাঠে নামবে প্রশাসন।

প্রসঙ্গত, বরিশালে শতাধিক কোচিং সেন্টার রয়েছে। আর এসব কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজারের বেশি।

কালের আলো/ওএইচ

Print Friendly, PDF & Email