এমপি ও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ‘আমলনামা’ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর টেবিলে

প্রকাশিতঃ 4:37 pm | August 08, 2018

অ্যাক্টিং এডিটর, কালের আলো :

দূয়ারে কড়া নাড়ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করে মাঠ গুছিয়ে আনতে স্বয়ং দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ জেলায় সাংগঠনিক সফর করছেন।

নিজেদের সময়ে দেশজুড়ে উন্নয়ন কর্মকান্ডের চিত্র তুলে ধরে পুনরায় নৌকাকে জয়ী করারও আহবান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকেও একাধিকবার দলীয় সংসদ সদস্যদের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো ও পুরোমাত্রায় জনসংযোগ করারও তাগাদা দিয়েছেন। সতর্ক করেছেন বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন সংসদ সদস্যদের। একই সঙ্গে তাদেরকে কড়া বার্তাও দিয়েছেন। আবার দলীয় মনোনয়ন পেতে তোড়জোড় শুরু করেছেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি।

সূত্র মতে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের আমলনামা ইতোমধ্যেই পৌছে গেছে দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেবিলে। প্রতিপক্ষের দলগত শক্তি, বিগত দিনগুলোতে প্রার্থীর ফলাফলসহ দলীয় ও বিভিন্ন জরিপ থেকে আসা পর্যবেক্ষণকে কাজে লাগিয়ে এবার দলটি তাদের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবে এমন ইঙ্গিত মিলেছে হাইকমান্ড সূত্রে।

সমস্ত যাচাই বাছাই ও আলোচনা-পর্যালোচনা শেষ করে কারা পাচ্ছেন নির্বাচনী টিকিট তার চূড়ান্ত ঘোষণা আসবে আগামী অক্টোবরে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর। একই সূত্র জানিয়েছে, দলীয় যেসব সংসদ সদস্য নিজেদের কর্মকান্ডে সংগঠন ও সরকারকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবারের মনোনয়নে তারা বাদ পড়তে যাচ্ছেন। ঝরে পড়তে পারেন জনবিচ্ছিন্নরাও। এসব আসনে আসতে পারে দলের পরীক্ষিত ও জনপ্রিয় নতুন মুখ।

দলীয় দায়িত্বশীল সূত্র ইঙ্গিত দিয়েছে, জোটের আসনগুলো ছাড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে বিজয় নিশ্চিত করতে পারবে এমন প্রার্থীদের একটি বড় তালিকা। সূত্র জানায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়া প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন সংসদ সদস্য মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়তে পারেন।

আবার কমপক্ষে শতাধিক আসনে জনপ্রিয় এমপিরা পুনরায় দলীয় মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন। বয়সের কারণেও কেউ কেউ বাদ পড়ার তালিকায় রয়েছেন।

দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, সংসদের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দল বিএনপি’র নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়াকে মাথাই রেখেই মাঠ গুছাতে ব্যস্ত রয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রার্থীর জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে এরই মধ্যে শেষ হয়েছে কয়েক ধাপের জরিপ। এক্ষেত্রে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বিগত দিনগুলোর ভোটে প্রার্থীর হিসাব-নিকাশ।

সূত্র মতে, সরকারি-বেসরকারি একাধিক সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে- নিজ নিজ নির্বাচনী আসনে জনপ্রিয়তা তলানীতে গিয়ে ঠেকা, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, দখল, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দল সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদেরকে পরাজিত করা, মাদক ব্যবসা এবং নিজেদের আখের গুছানোর অভিযোগ থাকা এমপিরা ঝুঁকিপূর্ণ। দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন করে এমপি লীগ তৈরি করেছেন।

নীতি নির্ধারক মহলের দেওয়া তথ্যে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় নাম থাকা উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন- গোপালগঞ্জ-৩ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, গোপালগঞ্জ-২ শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ঝালকাঠি-২ আমির হোসেন আমু, ফরিদপুর-৪ কাজী জাফরউল্লাহ, নোয়াখালী-৫ ওবায়দুল কাদের, সিরাজগঞ্জ-১ মোহাম্মদ নাসিম, নাটোর-৩ জুনাইদ আহমেদ পলক, কুষ্টিয়া-৩ মাহবুব-উল আলম হানিফ, দিনাজপুর-২ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বরিশাল-৪ পংকজ দেবনাথ, বরিশাল-৫ বেগম জেবুন্নেছা আফরোজ, মাদারীপুর-১ নূর ই আলম চৌধুরী লিটন, টাঙ্গাইল-১ ড. আবদুর রাজ্জাক, টাঙ্গাইল-২ মশিউজ্জামান খান রুমেল, জামালপুর-১ নূর মোহাম্মদ, জামালপুর-৩ মির্জা আজম, শেরপুর-১ আতিউর রহমান আতিক, শেরপুর-২ মতিয়া চৌধুরী, কিশোরগঞ্জ-১ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ-২ নূর মোহাম্মদ, কিশোরগঞ্জ-৪ রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, কিশোরগঞ্জ-৬ নাজমুল হাসান পাপন, ময়মনসিংহ-১০ ফাহমি গোলন্দাজ বাবেল, দিনাজপুর-৩ আসনে ইকবালুর রহিম, দিনাজপুর-৪ আবুল হাসান মাহমুদ আলী, দিনাজপুর-৫ মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, নীলফামারী-২ আসাদুজ্জামান নূর, লালমনিরহাট-১ উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল অথবা মহাজোট থেকে কেউ, লালমনিরহাট-২ নুরুজ্জামান আহমেদ, রংপুর-৪ টিপু মুন্সী, রংপুর-৫ এইচ এন আশিকুর রহমান, গাইবান্ধা-২ মাহাবুব আরা গিনি, জয়পুরহাট-২ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, বগুড়া-১ আবদুল মান্নান, নওগাঁ-১ সাধন চন্দ্র মজুমদার, নওগাঁ-২ শহীদুজ্জামান সরকার, নওগাঁ-৬ ইসরাফিল আলম, রাজশাহী-১ আসনে ওমর ফারুক চৌধুরী, বরিশাল-১ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, ঢাকা-৩ নসরুল হামিদ বিপু, ঢাকা-৯ সাবের হোসেন চৌধুরী, ঢাকা-১০ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা-১১ এ কে এম রহমতউল্লাহ, ঢাকা-১২ আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকা-১৩ জাহাঙ্গীর কবির নানক, নারায়ণগঞ্জ-৪ এ কে এম শামীম ওসমান, ফরিদপুর-২ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, ফরিদপুর-৩ ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও গোপালগঞ্জ-১ লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সামলে সমানতালেই শিল্পাঞ্চল তেজগাঁও-শেরেবাংলা নগর ও রমনার একাংশ নিয়ে গঠিত ঢাকা-১২ আসনের ভোটারদের আস্থা অর্জন ও হৃদয় জয় করেছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

এগিয়ে আসা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এ আসনটিতে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয় প্রার্থী হিসেবে তাঁর মনোনয়ন নিশ্চিত বলে মনে করেন দলটির নেতা-কর্মীরা। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার একাধিক জরিপেও তাঁর অবস্থান সুদৃঢ়। নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে টানা জয়লাভের পর এবার হ্যাট্টিক বিজয়ের পথেই হাঁটছেন মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

মনোনয়নের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দলীয় নেতা-কর্মী ও ভোটারদের জন্য নিবেদিত থেকে কাজ করার চেষ্টা করেছি। ঢাকা-১২ আসনটি এখন আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এখানে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত।’

ভোট রাজনীতিতে ‘দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ’ হিসেবে পরিচিত ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের প্রেক্ষিতে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়ে মনোনয়নে সবুজ সংকেত পাওয়া এই আসনের সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ বাবেল বলেন, ‘আমি কমিটমেন্টে বিশ্বাসী। আর এই কারণে এমপি হবার পর থেকেই দলের নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষের পাশে ছিলাম। আমার নির্বাচনী প্রস্তুতি মূলত শুরু হয়েছিল এমপি হবার পর থেকেই।’

গফরগাঁও উপজেলা আওয়ামী লীগের এই আহবায়ক বলেন, ‘আমার বাবা প্রয়াত কিংবদন্তি রাজনীতিক আলতাফ হোসেন গোলন্দাজের কাছ থেকেই আমি শিখেছি কীভাবে জনগণের সুখ-দু:খে সব সময় পাশে থাকতে হয়। দলের ভেতরে বাইরে এবং স্থানীয় ভোটারদের কাছে নিজের অবস্থান ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে কাজ করেছি। ইনশাল্লাহ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ভোটে রেকর্ড গড়ে নৌকা বিজয়ী হবে। আবারো আসনটি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে পারবো।’

কী বলছে হাইকমান্ড
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বিষয়ে দলটির সংসদীয় সম্পাদক নূর ই আলম চৌধুরী বলেন, ‘মনোনয়নের ক্ষেত্রে আমরা কয়েকটি বিষয় বিচেনা করি। এর মধ্যে আমাদের বিপক্ষে যারা নির্বাচন করবে তাদেরকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। তৃণমূলের মতামত নেওয়া হয়।

তৃণমলের মতামতের পাশাপাশি জেলার নেতাদের একটি মতামত গ্রহণ করা হয়। তারপর কেন্দ্রের মতামত, সার্ভে রিপোর্ট নেয়া হয়। এরপর মনোনয়ন বোর্ড বসে সব কিছু বিবেচনা করে নির্বাচনের জন্য কাকে যোগ্য সেটা নির্ধারণ করে।’

মনোনয়নের ব্যাপারে দলটির প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘মন্ত্রী, সিটিং এমপি বা দলের নেতা হলেই মনোনয়ন নিশ্চিত নয়। অনেকে জায়গায় একাধিক প্রার্থী রয়েছে আমাদের। যে কারণে আমাদের ওপর চাপটা খুব বেশি। পাশাপাশি আমাদের জোট আছে। তাদেরও অনেক চাহিদা আছে। যে প্রার্থীর এই মুহুর্তে এলাকাতে জনপ্রিয়তা বেশি এবং মানুষ যাকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে পাঠাতে চান আমরা তাদেরকেই বিবেচনা করবো।’

দলটির প্রভাবশালী আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ড.আব্দুর রাজ্জাক বলেন, জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতাসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে মনোনয়ন পার্লামেন্টারি বোর্ড মনোনয়ন দেবে। এ লক্ষে বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমে খোঁজ খবর নেওয়া হয়েছে।

কালের আলো/এএ

Print Friendly, PDF & Email