এ কোন ছাত্রলীগ, জাকির আছেন, সোহাগ নেই!

প্রকাশিতঃ 3:05 pm | January 07, 2018

বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো:
মাত্র এক বছর আগের ঘটনা। ছাত্রলীগের ৬৯ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগ। সেই ছাত্র সমাবেশে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মীদের মিলনমেলা বসেছিল নগরীর রেলওয়ে কৃষ্ণচূড়া চত্বরে। সমাবেশে ‘মধ্যমণি’ ছিলেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী ও আ’লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

উদ্বোধক ছিলেন ধর্মমন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান। ওই সময়ে জেলা আ’লীগের রাজনীতিতে বিবাদমান দু’পক্ষের নেতা-কর্মীদেরই সক্রিয় উপস্থিতি ছিল সমাবেশে। কিন্তু বছর পেরুতেই ঐক্যবদ্ধ ছাত্রলীগের বন্ধন আলগা হয়েছে।

এক বছর আগে যে চত্বরে মিলনমোহনা তৈরি হয়েছিল এখন সেখানেই বাজতে শুরু করেছে বিচ্ছেদের করুণ সুর! এবার ৭০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে ঘিরে আগামী ৮ জানুয়ারির ছাত্র সমাবেশে ময়মনসিংহে বিভক্ত ছাত্রলীগের রাজনীতির স্বাক্ষী হতে চলেছে নগরীর সেই রেলওয়ে কৃষ্ণচূড়া চত্বর।

গতবার ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রকিবুল ইসলাম রকিব ও সাধারণ সম্পাদক সরকার মোহাম্মদ সব্যসাচী’র আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ছাত্র সমাবেশ। আর এবারের আয়োজক জেলার সাধারণ সম্পাদক সব্যসাচী। সমাবেশের নিমন্ত্রণপত্র থেকে শুরু করে প্রচারণা-সব জায়গাতেই গ্রুপিং-কোন্দলে জর্জরিত সংগঠনটির যেন প্রকাশ্য আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সাবেক তুখোর ছাত্র নেতা ও ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দলীয় কোন্দল নিরসন দরকার। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এক পক্ষের এমন আয়োজন ঠিক নয়। সামনে নির্বাচন। সংগঠনে ঐক্য দরকার। তবে রাজনীতিকে কোন অবস্থাতেই পরিবারের শেকলে বাঁধা উচিত নয়।’

জানা গেছে, এবার ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের ছবি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সাধারন সম্পাদক এস.এম.জাকির হোসাইনের ছবি দিয়ে ছাপা হয়েছে নিমন্ত্রণপত্র। এক পক্ষের অনুসারী হিসেবে পরিচিত সাবেক ছাত্র নেতাদের প্রধান ও বিশেষ অতিথির তালিকায় রাখা হলেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা ডাকসাইটে সাবেক ছাত্র নেতাদের রীতিমতো উপেক্ষা করা হয়েছে।
স্বয়ং ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস.এম.জাকির হোসাইনকে ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, এমন কথাবার্তাও উচ্চারিত হচ্ছে অনেকের মুখে মুখে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের দামামা বেজে উঠার মুহুর্তে এমন প্রকাশ্য বিরোধ রাজনীতির অশনিসংকেত বলেই মনে করছেন মাঠের কর্মীরা।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এমন ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ আয়োজনকে ঘিরে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস.এম.জাকির হোসাইনের বক্তব্য জানতে বার বার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

জানা যায়, জেলা ছাত্রলীগ আয়োজিত ৬৯ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ছাত্র সমাবেশে প্রধান বক্তা হিসেবে রাখা হয়েছিল দলের ঘোর দু:সময়ে বৃহত্তম ময়মনসিংহ ছাত্রলীগের সভাপতি ও ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদকে।

বিশেষ অতিথির তালিকায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক ডাক সাইটে নেতা ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকা, স্থানীয় তরুণ দু’ সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ বাবেল ও শরীফ আহমেদ, ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র ও মহানগর আ’লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সহ-সভাপতি মো: ইকরামুল হক টিটু, মহানগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্তকে।

পক্ষ-বিপক্ষ মিলিয়ে অসাধারণ এক সমন্বয় ছিল সেই ছাত্র সমাবেশের পরতে পরতে। আর এতে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন স্বয়ং ধর্মমন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান। তিনি বলেছিলেন, ‘বিগত দিনগুলো এমন ছাত্র সমাবেশ কেউ করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও কেউ এমন সমাবেশ উপহার দিতে পারবে না।’

এবার ভাতিজা সব্যসাচীর বলয়ের আয়োজনে সমাবেশে ধর্মমন্ত্রী না গেলেও তাঁর ছবি ছাপা হয়েছে নিমন্ত্রণপত্রে। আর এতে প্রধান অতিথি করা হয়েছে মন্ত্রীপুত্র মোহিত উর রহমান শান্তকে। তিনি মহানগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক।

এ সমাবেশের নিমন্ত্রণপত্রে নাম নেই জেলা আ’লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকা, সাধারণ সম্পাদক ও আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলের।

দলের সঙ্কটে-দু:সময়ে যারা ছাত্রলীগকে নেতৃত্বে দিয়েছেন তাদের নামও উঠেনি নিমন্ত্রণপত্রে। ঘটা করে একটি সমাবেশে কেন এবং কী কারণে জেলা ছাত্রলীগকে বিভক্ত করে ক্ষোভ উস্কে দেয়া হচ্ছে এ নিয়েও দলীয় পরিমন্ডলেই নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

জানতে চাইলে এ বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রকিবুল ইসলাম রকিব বলেন, ‘৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে আমি সাধারণ সম্পাদক সরকার সব্যসাচীকে ৩ থেকে ৪ দিন ফোন দিয়েছি। সে আমার ফোন রিসিভ করেনি। ১৫ দিন সময় চেয়ে ওই সময় আমাকে সে একটি ক্ষুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠায়।

সে সাড়া না দেওয়ায় আমি সাবেক ছাত্র নেতাদের নিয়ে ৪ জানুয়ারি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, সমাবেশসহ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করি। ৮ জানুয়ারির ছাত্র সমাবেশের বিষয়েও সাধারণ সম্পাদক আমার সঙ্গে কোন কথা বলেনি।’

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রেও বলা হয়েছে, ‘সভাপতি সংগঠনের সর্ব প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে গণ্য হবেন। সভাপতির স্বাক্ষর ব্যাতিরেকে কোন প্রস্তাবই বিবেচিত হবে না।’ কিন্তু দলীয় সভাপতির অনুমতি ছাড়াই এমন আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করেছেন সাধারণ সম্পাদক সরকার সব্যসাচী।

সূত্র মতে, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে রকিব ও সাচী দু’ নেতার অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সাচী রাজনীতি করতেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের বেল্টে। কিন্তু হঠাৎ করেই সাচী মিশে যান দলীয় সাধারণ সম্পাদক এস.এম.জাকির হোসাইনের বলয়ে।

জাকিরের সিগন্যালেই সাচী ময়মনসিংহে রাজনীতি করে যাচ্ছেন। তিনি সমন্বয়ের নির্দেশ দিলে সাচী রকিবের সঙ্গে একীভূত হয়েই রাজনীতি করতেন। ৮ জানুয়ারির নিমন্ত্রণপত্রেও সাচী নিজের সঙ্গে জাকিরের হাস্যোজ্জ্বল ছবি জুড়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রেও দলীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগকে অবজ্ঞা করা হয়েছে বলে মনে করেন দলটির অনেক কর্মী। তবে সমাবেশে সভাপতিত্ব করবেন কে, এমন কারো নাম লেখা হয়নি।

ময়মনসিংহ জেলার এমন ছাত্র সমাবেশের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, ‘বিষয়টি তো আমার জানা নেই। আপনার মুখ থেকেই শুনলাম। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

দলীয় একাংশের নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ বলছেন, পরিবারের নেতাদের তুষ্ট করতেই এককভাবে ছাত্রলীগের ছাত্র সমাবেশের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন সরকার মোহাম্মদ সব্যসাচী। আর এক্ষেত্রে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন জেলার রাজনীতিতে নানা কারণে বিতর্কিত এক তরুণ সংসদ সদস্য।

বিভিন্ন কারণে তিনি জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রকিবুল ইসলাম রকিবের ওপর অসন্তুষ্ট। রাজনৈতিকভাবে রকিবকে ঘায়েল করতেই তিনি এমন দাবার চাল দিয়ে থাকতে পারেন বলেও জোর গুঞ্জণ চলছে নেতা-কর্মীদের মুখে।

দলটির মাঠ পর্যায়ের এক কর্মী বলেন, সোহাগ ও জাকির ছাত্রলীগে সবার নেতা। এ দুই নেতাও দাবি করেন ছাত্রলীগে কোন গ্রুপিং-কোন্দল নেই।

কিন্তু তাদের একজনের ছবি ব্যবহার করেই যখন বর্ণাঢ্য ইতিহাস, ঐতিহ্যের অধিকারী এ সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর নিমন্ত্রণপত্র ছাপা হয় তখন প্রশ্ন উঠে তাদের সম্পর্ক কী আদৌ ভাল না কী গভীর তিক্ততার!

দুই নেতা এসব বিষয় প্রশ্রয় না দিয়ে সরাসরি অ্যাকশনে না গেলে ছাত্র রাজনীতিতে তাদের শেষের দিনগুলো গ্রুপিং-কোন্দলের কলঙ্কের ছায়ায় পড়বে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

Print Friendly, PDF & Email