কোটা আন্দোলন কার?

প্রকাশিতঃ 9:07 pm | July 20, 2018

বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো :

সম্প্রতি কোটা আন্দোলন ইস্যুতে উত্তাল সময় পার করছে দেশ। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতরা কয়েকদিন পরপরই নেমে আসছে রাজপথে। কোটা আন্দোলনকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আখ্যা দিয়ে এ আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন দেশের কয়েকজন ডাকসাইটে বুদ্ধিজীবী ও তথাকথিত সুশীল সমাজ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোটা আন্দোলন কি আসলেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন? নাকি এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে অন্য কোনো অপশক্তি।

কোটা সংস্কার বা বাতিলের দাবির শুরুটা কীভাবে হলো? কে উত্থাপন করলো প্রথম মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে আমাদের একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী ২০০১ সালে যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় তখন নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারে তাঁরা সর্বপ্রথম সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করার দাবি এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করার দাবি উত্থাপন করে।

নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোট সরকার জয়ী হওয়ার পর প্রথম জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসে ২০০২ সালের ৮ জানুয়ারি। সেখানে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব ও আলোচনার সময় জামাতের সংসদীয় দলের নেতা এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী প্রথম বলেন যে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে দেওয়া দরকার। কারণ এই কোটার অপব্যবহার হচ্ছে, অপচয় হচ্ছে। নিজামী আরও বলেন, আলাদা মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখার কোনো প্রয়োজন নেই, পুরো কোটা ব্যবস্থারই সংস্কার করা দরকার।

এরপর জামাতের আরেক নেতা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগকারী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ২০০৩ সালে ৩৩ তম বাজেট অধিবেশনে বাজেটের ওপর আলোচনার সময় মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের জন্য দাবি উত্থাপন করেন এবং কোটা সংস্কারের দাবি করেন।

একই অধিবেশনে যুদ্ধাপরাধী মাওলানা আবদুস সোবহানও মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবি তোলেন। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংসদে কোটা সংস্কারের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদে ভাষণে বলেছিলেন, কোটা সংস্কার হওয়া উচিত। তবে বিভিন্ন কারণে এ বিষয়ে তখন আর অগ্রসর হতে পারেনি বিএনপি-জামাত জোট সরকার।

সে সময়টাতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল ইস্যুতে বেশি আগাতে না পারলেও নিজেদের এজেন্ডা থেকে বিষয়টিকে কখনো বাদ দেয়নি জামায়াতে ইসলামী। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের উদ্দেশ্যে ভেতরে ভেতরে কাজ করে গেছে তারা। এরই ধারাবাহিকতায় এবার সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগ পুঁজি করে শিবিরের ক্যাডারদের নেতৃত্বে তাঁদের আন্দোলন করতে মাঠে নামিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এই শক্তিটি। এই আন্দোলনের নাম তাঁরা দিয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলন।

যদিও শুরুর দিকে আন্দোলনকারীদের দেখা গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ছবি হাতে রাস্তায় নামতে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্যামোফ্লাজের আড়ালে এই আন্দোলনের মূল টার্গেটই ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল।

যত দিন গেছে আন্দোলনের পেছনের এই মূল উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের গুলিতে ছাত্র মারা গেছে, ছাত্রলীগ নেত্রী এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনকারীরা ক্রমাগত দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে গেছেন। ঢাবি উপাচার্যের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নাশকতাও করেছে নিজেদের মেধাবী দাবি করা এই কোটা আন্দোলনকারীরা। এক পর্যায়ে আমি রাজাকার, রাজাকারের বাচ্চা আমি আমার পিতা শেখ মুজিবের মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ স্লোগান মুখে এঁকে, প্ল্যাকার্ডে লিখেও পথে নামতে দেখা গেছে আন্দোলনকারীদেরকে। আর এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল ঘৃণিত রাজাকার শব্দটিকে একটি সাধারণ শব্দের পর্যায়ে নামিয়ে আনা।

এরপর বিভিন্ন সময়ে কোটা আন্দোলনের মূল আহ্বায়কদের কথাবার্তা থেকেও স্পষ্ট হয়েছে, কোটা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করা। বারবার তাঁদের কথাবার্তায় উঠে এসেছে তাঁদের আপত্তির জায়গাটি ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা। কোটা আন্দোলন যে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন নয়, এর পেছনে যে কলকাঠি নাড়ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি তা সময়ের সঙ্গে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।

জামাত মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরোধিতা করবে এ নিয়ে বিস্ময়ের কিছু নেই। জামাত একাত্তরের পরাজিত শক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার, বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারই বিরোধী তাঁরা। এই বিরোধিতা একাত্তরে নিকৃষ্টতম রূপ ধারণ করেছিল। নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানি চালিয়েছিল তখন জামায়াতে ইসলামী।

স্বাধীনতার পর ৪৬ বছর কেটে গেছে, রাজাকার-আলবদরদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওঠার মতো লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অবস্থানে কোনো হেরফের হয়নি। তাই জামাত যখন থেকে প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৯৬ সালে প্রথম বারের মতো ক্ষমতায় এসেই সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত রাখার ঘোষণা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। আর তখন থেকেই এই মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরোধিতা করে আসছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী।

কিন্তু দুঃখের বিষয়টি হচ্ছে, দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ, বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীগণ এবং নিজেদের সেক্যুলার রাজনীতির প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করা দেশের বাম দলগুলোও এই আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছে। তাঁরা নাশকতার অভিযোগে আটক কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান, এ বি এম সুহেলের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করছেন, তাঁদের মানববন্ধন থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে আপত্তিকর ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে।

এই শ্রেণিটি কলাম লিখে, সংবাদ সম্মেলন করে ক্রমাগত মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করে যাচ্ছে, যার সুফল আসলে ভোগ করছে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিটি। এই বুদ্ধিজীবীরা বুঝতেই চাইছেন না কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে তাঁরা জামাত-শিবিরের চক্রান্তে পা দিয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের উদ্দেশ্য-বিধেয় বিশ্লেষণ না করে কেবল আবেগী হয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার মাধ্যমে যে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পথ সুগম হচ্ছে সেটিও মানতে চাইছেন না তাঁরা।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের জায়গা। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবি তোলার অর্থই হলো মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সন্তানদের অসম্মান করা। আর কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করার এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করছে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি জামাত-শিবির। আর চিন্তাভাবনা না করেই তাঁদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে দেশের সুশীল সমাজ।

কালের আলো/এএ

Print Friendly, PDF & Email