ময়মনসিংহের ডিবি’র ওসি’র বদলী রহস্য কী?

প্রকাশিতঃ 7:51 pm | July 09, 2018

অনিক খান, অপরাধ প্রতিবেদক, কালের আলো :

মাদক ব্যবসায়ী বা অপরাধীদের কাছে তিনি পরিচিত মূর্তমান এক ‘আতঙ্ক’ হিসেবে। ছিনতাইকারীদের কাছেও যেন এক ‘যমদূত’। গোটা দেশে যখন মাদক বিরোধী ‘অল আউট’ কর্মসূচি শুরু হয়েছে এক মাস পর, ময়মনসিংহে সেটি শুরু হয়েছিল সপ্তাহ তিনেক আগেই। এই অভিযানেরও নেতৃত্ব ছিলেন তিনি।

‘বন্দুকযুদ্ধ’ কিংবা দুই পক্ষের ‘গোলাগুলি’ নিহত হয়েছেন ২৭ মাদক সম্রাট। লন্ডভন্ড করে দিয়েছেন মাদকজোনগুলোও। অস্ত্র উদ্ধারেও কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। মাত্র এক বছরেই গোটা ময়মনসিংহে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। জনমনে কুড়িয়েছেন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় হয়েছেন সিক্ত। তিনি আশিকুর রহমান।

ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। এই স্বল্প সময়েই নিজের কর্মগুণে তিনবার রেঞ্জে এবং চার বার জেলায় শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। এইসব পুরনো গল্প। নতুন বাস্তবতা হচ্ছে- মাদক বিরোধী অভিযানে সাহসীকতার পাশাপাশি দায়িত্বশীলতার নজির স্থাপন করা এই পুলিশ কর্মকর্তাকে হঠাৎ করেই বদলী করা হয়েছে। পুলিশের ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি নিবাস চন্দ্র মাঝি দুইদিন আগে তাকে শেরপুরে বদলী করেছেন।

আর এই বদলীর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই নতুন এক আতঙ্ক চেপে বসেছে ময়মনসিংহে। মাদক বিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে ময়মনসিংহ থেকে নিরাপদে অন্য জেলায় সটকে পড়া রাঘব-বোয়াল মাদক ব্যবসায়ীরা নড়েচড়ে বসেছেন। স্বস্তির শ্বাস ফেলতে শুরু করেছেন তারা।
হুংকার দিচ্ছেন, আবারো সাম্রাজ্যে ফিরে পুরনো স্টাইলেই শুরু করবেন মাদকের কারবার। স্বেচ্ছায় কারাবরণ করা মাদক ব্যবসায়ীদের মুখেও হাসির ঝিলিক। তারাও কারাগার থেকে বেরিয়ে পুরনো ব্যবসায় মন দিতে চাইছেন। প্রস্তুত রেখেছেন আইনজীবীদেরও। ফলে ময়মনসিংহ নগরীর সচেতন বাসিন্দাদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা নতুন করে জেঁকে বসছে।

আবারো পুরনো স্টাইলে মাদক ব্যবসায়ীরা লম্ফঝম্ফ করে এলাকায় ফিরলে কী দরকার ছিলো মাদক বিরোধী এমন চলমান অভিযানের? এমন প্রশ্নও করছেন কেউ কেউ। তবে সবার মাঝেই মোটা দাগে একটি প্রশ্ন ওঠছে, শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও গডফাদারদের কাছে আতঙ্ক হয়ে ওঠা এই পুলিশ কর্মকর্তাকে হঠাৎ করেই কেন বদলী করা হলো?

মাদক বিরোধী চলমান অভিযানে দাঁড়ি টানতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী, পেশাদার এই পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলী করার মধ্যে দিয়ে ‘টিম ডিবি’র মনোবল ভেঙে দিতেই কী নেপথ্য কুশীলবরা অবশেষে সফল হলেন? মাদকের পৃষ্ঠপোষকরা আনন্দ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে মাদকের সর্বনাশা ছোবল আবারো গ্রাস করবে ময়মনসিংহকে এমন কথা কথাও স্থানীয় জনসাধারণের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।

সূত্র মতে, ময়মনসিংহে গত কয়েক মাসে মাদক বিরোধী চলমান অভিযানে ইয়াবা-ফেন্সিডিল সাম্রাজ্যে হাহাকার তৈরি হয়েছে। হাত বাড়ালেই এক সময় যেখানে মিলতো ইয়াবা-ফেন্সিডিল সেখানে এমন চরিত্র মনোবল ভেঙে দিয়েছে ইয়াবাসেবীদের।

অনেক ইয়াবাসেবী ইয়াবা সেবন করতে না পেরে ‘মরণ’ এই নেশা ছেড়ে দেওয়ারও ভাবনা চিন্তা করছেন। আর নিরবিচ্ছিন্ন অভিযানের মাধ্যমেই এমন অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন ডিবি’র ওসি আশিকুর রহমান।

দৈনিক কালের আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদক বিরোধী চলমান সাঁড়াশি অভিযানে ময়মনসিংহ পুরোপুরি মাদকমুক্ত না হলেও এবং রাঘব-বোয়াল মাদক ব্যবসায়ীরা এখনো পুলিশের কব্জায় না আসলেও দামে রেকর্ড গড়েছে ইয়াবা। ২০০ টাকার ইয়াবা আড়ালে-আবডালে থেকে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। একটি ইয়াবা বড়ি কিনতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে সেবীদের। কোন কোন সময় একটি ইয়াবা বড়ি সংগ্রহ করতেই ৬ থেকে ৭ ঘন্টা সময় লেগে যাচ্ছে। অথচ এক সময় ইয়াবা ছিল মামুলী ব্যাপার। আর এখন ‘সোনার হরিণ’।

সূত্র জানায়, ডিবি’র ওসি আশিকুর রহমানের আগে নিকট অতীতে মাজেদুর রহমান ও ইমারত হোসেন গাজী সামলে গেছেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এর মধ্যে মাজেদুর ২০-১১-২০১৩ থেকে ০২-০৩-২০১৫ এবং গাজী ০৩-০৩-২০১৫ থেকে ০৫-০৭-২০১৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন নির্বিঘ্নেই।

কিন্তু অপরাধী বা রাঘব-বোয়ালদের ‘তোয়াজ’ না করা আশিকুর রহমানের ময়মনসিংহের ডিবি অধ্যায় শেষ হতে যাচ্ছে মাত্র এক বছরেই। জেলার প্রভাবশালী মাদক গডফাদারদের মোটা অঙ্কের বিনিয়োগের মাধ্যমেই ষড়যন্ত্রের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন আশিকুর রহমান, এমন প্রশ্নও ওঠেছে।

জানা গেছে, পুলিশের ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি নিবাস চন্দ্র মাঝি ও জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ নুরুল ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনায় মাদক বিরোধী ‘যুদ্ধে’ অবতীর্ণ হন আশিকুর রহমান। কিন্তু তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঠিকই ষড়যন্ত্রকারীদের বোলিংয়ে ‘বোল্ড’ আউট হতে হচ্ছে ডিবি’র প্রশংসিত ওসি আশিকুর রহমানকে।

তাঁর বদলীর খবরে সরগরম হয়ে ওঠেছে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। তাঁর বদলী প্রত্যাহারের দাবিতে গর্জে ওঠেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাঁরা হুমকি দিয়েছেন বদলীর দাবি প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধনের। পাশাপাশি ঠিক বিপরীত চিত্র মাদক ব্যবসায়ীদের। ডিবি’র ওসি’র বদলীর খবরে মাদক জোন হিসেবে পরিচিত কৃষ্টপুর, চামড়াগুদাম, শম্ভুগঞ্জ, আকুয়াসহ বিভিন্ন পয়েন্টে মাদক ব্যবসায়ীরা একে অপরে মিষ্টি বিতরণ করছেন। দ্রুতই ময়মনসিংহ নগরীতে ফিরে পুরনো কারবার শুরু করারও হাঁকডাক দিচ্ছেন ওই মাদক ব্যবসায়ীরা।

কালের আলো/ওকে/ওএইচ

Print Friendly, PDF & Email