আত্মশক্তির ‘উৎস’ সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ ও অদম্য ‘টিম সিএমএইচ’ (ভিডিও)

প্রকাশিতঃ 8:50 am | June 04, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

ঠিক যেন মৃত্যুর দূয়ার থেকে জীবনের দিকে পালিয়ে এসেছেন। জয় করেছেন ‘মৃত্যুভয়’।

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও এক মুহুর্তের জন্যও তার ইচ্ছাশক্তিকে হারতে দেয়নি অদম্য চিকিৎসকরা।

সার্বক্ষণিক মোটিভেশনের পাশাপাশি চাঙ্গা রেখেছেন মনোবল। চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ডবয়রা মিলে ‘একটি টিম’ হিসেবে নিরবিচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করছেন।

ফলশ্রুতিতে করোনাকে পরাজিত করে জীবনযুদ্ধে জিতেছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান চৌধুরী। তাঁর মতোই একইভাবেই বেঁচে উঠছে আরও শত শত প্রাণ।

প্রত্যেকেই জয়ধ্বনি করছে শুভ্র, সুন্দর, প্রীতি-উজ্জ্বল নতুন জীবনের। করোনাকালের অন্ধকার জীবনের মলিনতা মুছে স্নাত হচ্ছেন নতুন আলোয়!

দু:সহ করোনা নিজেদের চিন্তা-চেতনা ও জীবনবোধকে পুরোপুরি নাড়িয়ে দিলেও করোনা ‘পজিটিভ’ ও ‘নেগেটিভ’ শব্দ দু’টিও যেন তাদের মনে গেঁথে আছে শক্তভাবেই।

করোনাকে জয় করার নিজের অভিজ্ঞতার এমন গল্পই সবাইকে শোনিয়ে গেছেন মাহমুদুর রহমান চৌধুরী। অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা প্রাণাবেগ ছন্দমিশ্রিত সরল লেখনীতে উপস্থাপন করেছেন নিজের ভেতরকার আবেগ-অনুভূতিকে।

নিজের মেধা-মনন আর সৃজনশীলতায় বাস্তব ঘটনা প্রবাহের অনন্য উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালকে (সিএমএইচ)। নিজের দ্বিতীয় জীবনের জন্য ধন্যবাদও জানিয়েছেন তাদের।

মৃত্যুকে হার মানিয়ে পুর্ণোদ্যমে জীবন মুখরতার সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার হৃদয়ছোঁয়া গল্পে পুরোমাত্রায় ‘দীপ্যমান’ হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

সৎ, দক্ষ ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি নিজের বহুমাত্রিক আলোকছটার ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন দেশপ্রেমিক এই বাহিনীতে।

দক্ষ ব্যবস্থাপনার পথিকৃৎ সিএমএইচ
করোনা যুদ্ধে সিএমএইচের প্রথম সারির সম্মুখ যোদ্ধা চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ডবয়রাও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন অবসরপ্রাপ্ত সেই সেনা কর্মকর্তার জবানীতে। দক্ষ ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যবান্ধব সেবা নিশ্চিতেরও পথিকৃৎ হয়ে উঠেছে এই সামরিক হাসপাতালটি।

বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে একেবারেই তছনছ করে দেওয়া ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাস নিত্যদিনই আক্রান্ত আর মৃত্যুর নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে দেশ-বিদেশে।

সঙ্কটময় এমন সময়ে প্রত্যেকেই পরস্পরের কাছাকাছি থাকতে চান, সময় পার করতে চান একসঙ্গে।

কিন্তু অন্যান্য চিকিৎসা অঙ্গনের মতোই ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) করোনার থাবা থেকে মানুষকে মুক্ত করে তাদের মুখে হাসি ফুটাতে নিরন্তর প্রচেষ্টায় অবিচল চিকিৎসক বা নার্সদের সেই জো নেই।

তাদের দিন-রাত সেবা-শুশ্রুষায় এখানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৬১৬। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ হাজার ২৫০ জন।

সিএমএইচে করোনায় কারও মৃত্যুতে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, নার্স বা ওয়ার্ডবয়দের যেমন বুক ফাটে তেমনি কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে তাদের আনন্দেও যেন হয়ে উঠে সীমাহীন।

নিজেদের জীবনের ঝুঁকিতেই তারা ঘুচিয়ে দিচ্ছেন গভীর আঁধার। জাগিয়ে তুলছেন সঙ্কটাপন্ন জীবনকে।

১৬ দফা নির্দেশনাতেও সিএমএইচের চিকিৎসকদের গুরুত্ব সেনাপ্রধানের
নিজের ১৬ দফার অভূতপূর্ব ও যুগান্তকারী নির্দেশনাতেও সিএমএইচের চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

বলেছেন, ‘চলমান করোনা যুদ্ধে সিএমএইচসহ মেডিক্যাল কোরের সকল সদস্যগণ প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আপনাদের এই সেবা এবং ত্যাগ, দেশ ও সেনাবাহিনী শ্রদ্ধাভরে স্মরণে রাখবে। আমরা সবসময় আপনাদের পাশে আছি।’

বুধবার (০৩ জুন) দিনমান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর মাহমুদুর রহমান চৌধুরীর ভাইরাল হওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসটিতে ঢাকা সিএমএইচে কোভিড-১৯ আক্রান্ত একজন রোগীর আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা-অভিলাষ, সঙ্কট-সাফল্য উঠিয়ে এনেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়।

সিএমএইচের সেবার অপূর্ব মাধুর্যতাকে তিনি অন্তরাত্না দিয়েই উপলব্ধি করেছেন। এর আগে মঙ্গলবার (০২ জুন) সুস্থ হয়ে তিনি সিএমএইচ ছেড়ে বাড়ি ফিরেছেন।

নিজের স্ট্যাটাসে মাহমুদুর রহমান চৌধুরী লিখেছেন- ‘একজন মারা যাওয়ার আগেই কভিড-১৯ তাকে মেরে ফেলে! সত্যিই কী তাই।

আমি যখন হাতে প্রথম আমার কভিড-১৯ পজিটিভের রিপোর্ট পাই, সে সময় নিজেকে নিজে স্পর্শ করে আগে নিশ্চিত হয়ে নেই- সত্যিই কী আমি বেঁচে আছি?

দ্বিতীয় পরীক্ষার পর কভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট হাতে আসার পর আমার রক্ত হিম হয়ে যেন জমে যায়। অন্যদের অনুভূতি কেমন ছিলো আমার জানা নেই, কিন্তু কভিড-১৯ আমার মধ্যে তৈরি করে এক ‘মৃত্যু ভয়’।

এ এক ভয়াবহ হতাশা। করোনার মত এমন একটি অজানা ভাইরাস নিজের শরীরে নিয়ে আছি এটা কতটা ভয়ের তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’

অবসরপ্রাপ্ত মেজর মাহমুদুর রহমান চৌধুরী আরও উল্লেখ করেছেন- ‘আমার আগে যারা আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে এমন অনেককে এখনো হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসায়। অনেকে এখনো তীব্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে করোনার সঙ্গে। এটি সত্যিই কষ্টকর।

পুরোপুরি বিষয়টা বোঝাবার মতো কোন ভাষা আমার জানা নেই। আগামী আরো ১০ দিন আমাকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।

আমার ড্রাইভার বিশ্বাস করেনি যে আমার শেষ পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এসেছে, আর সে কারণেই বাসায় যেতে হাসপাতালে গাড়ি নিয়ে আসতে হয়েছে আমার স্ত্রী ও ছেলেকে।

কিন্তু কিভাবে কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ করলাম? আমার আত্মবিশ্বাসের প্রথম স্থান ছিলো সিএমএইচ হাসপাতাল।

এই হাসপাতালে প্রথমসারিতে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা সেবা দেয়া সকলকে স্যালুট জানাই। এখানকার প্রায় সকল ডাক্তার এবং নার্সদের বাড়তি সময় খাটতে হয়েছে এই করোনা রোগীদের নিয়ে।

তারা এখানে ৭৫০ জনের বেশি রোগীকে হাসিমুখে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় করোনার চিকিৎসা দেয়া অধিকাংশ হাসপাতালই একত্রে এত সংখ্যক করোনা রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে বলে মনে হয় না।’

ভেঙেছেন প্রথাগত ও অনগ্রসর চিন্তার দেয়াল
করোনা আক্রান্তদের সঙ্কটের সাহস বা প্রতিরোধের প্রেরণাও স্বাভাবিকভাবেই জাগিয়েছেন মাহমুদুর রহমান চৌধুরী।

আর নিজে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা বলেই কীনা নিজ বাহিনীর চেতনার রঙও স্পষ্ট করতে পেরেছেন সাবলীলভাবেই। প্রথাগত ও অনগ্রসর চিন্তার দেয়াল ভেঙে দিয়েছেন নিজের ভাষায়।

নিজ বাহিনীর সর্বোচ্চ পদে থেকেও প্রতিটি সদস্যের আবেগ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকেও কীভাবে প্রতিনিয়ত আপন মহিমায় স্পর্শ করছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, নিজের দেখার দৃষ্টিতেই সেই বিষয়টি চমৎকারিত্বের মধ্যে দিয়েই উপস্থাপন করেছেন অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে করোনা প্রতিরোধের যুদ্ধে সামনে থেকেই তিনি সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এসব প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ‘এই সিএমএইচ সরাসরি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত হচ্ছে।

এখানের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে তিনি খোঁজ রাখেন যা শুনলে যে কেউ অবাক হবেন। আমি বিশ্বাস করি মানুষের কল্যাণে মেডিকেল সেবার গুরুত্ব কী তা প্রচন্ডভাবেই অনুভব করেন বাংলাদেশের সেনা প্রধান।

তার পরিকল্পনা, উষ্ণ আমন্ত্রণ, সহায়তা, দিক নির্দেশনা এবং যত্ন নেয়া সবই একজন করোনা রোগীকে তার সেই ভয়ের টানেল থেকে বেঁচে থাকার আলোর পথে নিয়ে আসে’ যোগ করেন মাহমুদুর।

সেনাপ্রধানকে সবাই পেয়েছেন আত্নশক্তিরূপেই
হালের করোনা যুদ্ধে নিজ বাহিনীর বর্তমান তো বটেই, সাবেক সেনা কর্মকর্তারাও যেন জেনারেল আজিজ আহমেদকে পেয়েছেন আত্নশক্তিরূপে।

কর্মের দ্যুতি ছড়িয়েই সিএমএইচে চিকিৎসাধীন করোনা আক্রান্ত প্রতিটি রোগী এমনকি অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের বুদ্ধি-বোধে-মর্মে-কর্মে যেন সারাক্ষণ আছেন সেনাপ্রধান।

এসব রোগীর জন্য তার মানবিকবোধ, জীবন ও দর্শন এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার নামান্তর। করোনাকালে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন রোগীরা যেন তার সুস্মিত প্রশ্রয় ও উদার অভিভাবকত্ব পেয়েছেন, নিজের জবানীতে এমন ইঙ্গিতও করেছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান চৌধুরী।

সৃজনশীল মানুষ মাত্রই যেমন ভিন্নতর অমরত্বের আত্মগত এক স্পৃহায় মগ্ন থাকেন এ বিষয়টিও যেন মোটা দাগেই উপজীব্য করে তুলেছেন তিনি।

বলেছেন, ‘প্রতিটি সেনা সদস্যের জন্য সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের চিন্তা ভাবনা অন্য যে কারো থেকে আলাদা।

বর্তমানে সেনাবাহিনী থেকে অবসর পাওয়া মানুষগুলো সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করতে পারে যা পূর্বে কল্পনাও করা যেত না। অবসর নেওয়া সহযোদ্ধাদের কল্যাণে সেনাপ্রধানের বাড়িয়ে দেয়া এই হাত বর্তমানে কর্মরত সেনা সদস্যদের আরও উজ্জীবিত করছে।’

উদ্ভাসিত সিএমএইচের ফ্রন্টলাইন ফাইটাররা
সিএমএইচের ফ্রন্টলাইন ফাইটাররা করোনা যুদ্ধে নির্বিঘ্নে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি আপন সৃজনমহিমায় উদ্ভাসিত করেছেন নিজের বাহিনীকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, করোনাকালে এখানে প্রায় ১ হাজার ৮’শ রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে করোনা জয় করেছেন প্রায় ৯’শ রোগী। এখন চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরও ৮ থেকে ৯’শ।

ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তৌহিদ এইচ সিদ্দিকের ‘টিম ওয়ার্কে’ অনেকেই স্বাক্ষর রেখেছেন স্বতন্ত্রতার।

তাদের অদম্য সাহসিকতা ও মমতার পরশেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন মাহমুদুর রহমান চৌধুরীর মতো করোনা আক্রান্ত রোগীরা। সেই কথাটিও গুরুত্বের সঙ্গেই উচ্চারণ করেছেন মাহমুদুর। ‘আমি জানি আপনারা কেউ প্রশংসা পেতে কাজ করছেন না।

কিন্তু আপনাদের প্রশংসা না করে পারছি না। বিশেষত সেনাপ্রধান এবং সিএমএইচ হাসপাতালে থাকা তার দুর্দান্ত দলের সদস্য কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তৌফিকুল হাসান সিদ্দিক, চীফ ফিজিশিয়ান ব্রিগেডিয়ার আসিফ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফা শহীদ, কর্নেল নাজমা, ল্যাফটেন্যান্ট কর্নেল তানিয়া, মেজর রোমেল, মেজর সাবিকুন, মেজর শারফিনসহ সকলকে।’

কালের আলো/এসএম/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email